Monday 9 April 2018

বেবী সাউ






নিশিডাক

এক।

এভাবে প্রতিটি রাত্রি কেঁপে ওঠে অসহায় যেন 
দূরে ভাঙা লরী যায় ঝনঝন হুইসিল বাজে 
কে তাকে ফেরানো ছলে পিছু ডেকে বলে -একদিন 
দেখো ওই দূরে আলো। যাকে তুমি পাহারাতে রেখে
সমস্ত শহর নিভে গেলে ফেরো নিশ্চিত দরজাতে 

দুই। 

আমিও সাজাই রোজ এই ভ্রম বেঁচে ওঠা টুকু 
চারপাশে হেসে ওঠে নিশিডাক ইশারাতে ডাকে 
কারণিশে ঝুলে থাকে দুর্মুখ আলোক। চাঁদ ভেবে 
আমিও হত্যার ছলে চুপিচুপি  ভালোবাসি তাকে 
খিলখিল করে ওঠে জমানো জারুল নীল সুর 
শোকাহত ভাবে হেঁটে যায় পোষা রাতের ফড়িং 
ক্ষিদে আরো বেড়ে ওঠে চারপাশ আরো শুনশান 
হত্যার মুহূর্তে জেনো সবকিছু স্তব্ধ হয়ে থাকে 

তিন। 

দূর থেকে ভেসে আসে বেড়ালের থাবা খসখসে 
নখের আওয়াজে ঘুম জেগে ওঠে ক্ষত গভীরতা 
অন্ধকার গাঢ় হয় আরো, হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে 
ইতিউতি খুঁজি সেই  প্রভূত আগুন দেশলাই 
ঘর্ষণের শব্দে ঘুম ভেঙে যেতে পারে ভেবে তুমি 
বালিশের খাঁজে পোষো ভেজা চোখ জলজ আকার
কান্নার প্রভূত অর্থ হত্যাকারী মুছে দিতে পারে 
ভেবে চারপাশে পোঁতা হয় তীক্ষ্ণ  লোহার পেরেক

চার। 

প্রকৃত কুশল জেনে তুমিও বাড়াও শিকারীর 
চোখ। কোনখানে বিদ্ধ সেই তীর বরাবর ভেদ 
করে ছুঁয়ে দিতে পারে সমস্ত আওয়াজ নিশিঘোরে 
পালিত শহর এই সময়ের স্রোতে ভেঙে দেয় 
ঘাত প্রতিঘাত ব্যর্থ ব্যারিকেড শুধু মিছিলের 
ভয়ে একা হয়ে যায়; পুলিশের চোখ আসে গন্ধ 
শুঁকে শুঁকে। অসহায় রাজপথ। এ বাংলা মদের ঠেক 
দূরে আরো দূরে শূন্য আলপথ দলমার ক্ষেত 
একাকী মহুল বন সাপের ছোবলে মৃতপ্রায় 
বিক্রির বাজারে তুমি তাকে রোজ দরদাম করো 

পাঁচ। 

যতটা গভীর হল এই রাত এই কেনাবেচা 
চারপাশ থেকে সরে গেল যারা শিকারের লোভে
ঘুমন্ত রাষ্ট্রের বুকে পাথরের মত চেপে বসে 
লরির চালক তার ভয়াবহ ক্ষুধার্ত চোখের 
ছোবল; প্রত্যহ লোভ আর জিঘাংসার বশে বলে --
'জেগে ওঠো, জাগো, দেখ ঘুমানোর সময় হয়নি'
চোখে ঢুকে গেছে ভাঙা পিচ আর মৃত সন্তানের 
দেহ। চারপাশ থেকে ভেসে আসে পচা পচা গন্ধ ; 
রহস্য গল্পের খুনী; ভয় করে। হত্যা শিখিয়েছে 
তারাই আমাকে রোজ; দোষারোপ; প্রকৃত ঘাতক 

ছয়। 

নির্বাক শহুরে পথ মানুষের কোলাহল নেই 
প্রকৃত সময় ভেবে পরে নেয় তীব্র বাঘনখ 
বিষপাত্র মিশে যায় সুবর্ণ জলের শান্ত স্রোতে
ধীরে ধীরে লীন হয়ে ওঠে সমস্ত শহর। অবস্থান।
আর রূপকথা ভেবে বহুকাল বহুকাল পরে 
শ্মশানের পথ নেই চারপাশে মৃত নগরীর 
কিছু বাসি খই, পোকা ধরা চাল, মুড়ি ও মুড়কি 
হাটে বিক্রি হয়। সাদা সাদা চোখ। মূর্তি রূপে ফেরে। 
পর্যটক আসে হাত বোলায়-- অধিক আগ্রহের,
ঝোঁকে আর নীচু হয়ে খোঁজে সেই আজন্ম আগুন 
পোড়ানোর আগে তাকে-- রাজকর্মী সহজে নেভায়  

সাত। 

ধীরে ধীরে ঘুমে ফেরে, গভীরে মিলায় ক্ষত দাগ 
ধানের শরীরে এসে বসে কালো কালো মাছি 
শোক নেই গান নেই চুপচাপ নিজেকে মেলায় 
অতীত অতীতে থাক বেঁচে থাকা বড় প্রয়োজন 
মা নেই বাবাও নেই। শুধু নিজে আর নিজে 
কঠিন সময় বড় সন্ধ্যাগানে মৃত সন্তানের 
মুখ ভাসে। হেতালের লাঠি হাতে ঘোরে লরির চালক 
পলাতক শীতে ফেটে যাওয়া ঠোঁট, তাচ্ছিল্য ছিটোয় 
পথে পথে সেই রক্তদাগে জেগে ওঠে শরবন 
নাও, রাষ্ট্র ভাবো, ভাবো কে নেভাবে গুপ্ত উপবন!

আট। 

তারপর ভোর হয়। আলো হয়। দৃশ্য  চারপাশ
আমাদের অবয়বে দরজা খোলে। দেখি চোখ নেই 
রাতের ইঁদুর সেই কেটে দিয়ে গেছে শব্দ, ভাষা  
বলার থাকেনা কিছু হাতড়িয়ে খুঁজি পুরোনো শহর
যাতায়াত। সড়কের ওপর সে মিছিলের বেদী 
ভুল হয়। আমাদের চোখ নেই কোনও। নির্দিষ্ট 
হাওয়ায় হারায় আর রাজদূত এসে বলে-- "ভুল 
সব ভুল। সত্য এই-- কতকাল তুমি ভুল ছিলে
রাষ্ট্রদ্রোহী। আজ স্পষ্ট। তোমাদের পূর্ব পুরুষেরা 
প্রাচীন শহর ভেবে সবকিছু মৃত রেখে গেছে" 
মেনে নিই। আবারও সে  দৃশ্যহীন। শব্দ অপ্রতুল 
কী আর বলার থাকে! প্রকৃত নিয়মে ভেঙে যায় 
ভগ্নদূত আসে একা। বসে। দরজা খোলে-- কেউ নেই? 
শহর দেখেনা কিছু। নতমুখ শুধু হেঁটে যাও

নয়। 

দু-কুচো আগুন জ্বলে, সামান্য গ্রহণ, কেটে যাবে
ভাবে। কত বর্ষকাল চুপ থাকে ক্ষুধিত পাষান
ধীরে ধীরে জয়গাথা লেখে। লেখে কতটুকু রাগ 
ভৈরব ছড়াতে পারে শহরকে যে জাগাতে হবে 
ফেরানোর প্রয়োজন আজ, নিশিডাকে যারা গেছে 
হাহাকার ছাড়া আর কিছু পায়নি তারাও 
পেঁচা ওড়ে ঝটপট করে, ডানা থেকে খসে পড়ে ওড়া 
চমকে উঠেছে রাত্রি, রাতের জরায়ু থেকে আলো 
ধীরে ধীরে ঘরে ফেরে, বলে ভাত দাও খেতে বসি 

দশ। 

সামান্য আগুন সেই দাবানল জ্বালে শহরের 
মৃত, ঝরে পড়া পাতা; নিভানো শ্মশান জেগে ওঠে 
গভীর হত্যার ক্ষতে বয়ে যায় নীল স্রোত, নদী 
সেই ঈর্ষা দগ্ধ গাছ, সেই শকুনির তীক্ষ্ণ চোখ 
নিভে যায়। পাশাপাশি হাঁটে কাঁধে কাঁধ আলো জ্বালে 
শহরের মাঝখানে জলস্রোত প্রচন্ড প্রবাহে 
মুছে দেয় ক্ষত কাঁটা; লোহার পেরেক ভেঙে ছোটে 
ফলের বাগানে সেই দৈত্য মৃত পড়ে আছে যেন 
তুমি তাকে হত্যা ভেবে নির্মম লাথিকাঘাত করো

4 comments:

  1. ধন্যবাদ অমিতদা

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো হয়েছে

    ReplyDelete
  3. প্রতিটি কবিতা গভীর মর্মার্থ বহন করছে। অনন্য উপস্থাপন।

    ReplyDelete