Wednesday 11 April 2018

ফিরে পড়া কবিতা- কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী





নাড়ী নক্ষত্র
তুমি কি আমার নাড়ী বুঝতে পারো,
নক্ষত্রও জানো ।
আলতো হাত রেখে দপ দপ লাফানো কবজিতে-
এক নিমেষেই বলে দাও, চারচক্ষু চর,
কে আমার সমস্ত ছন্দের উৎস ;
যেন তার পিতৃধাম, মাতৃকূল, নখাগ্রে নামটি!
বন্ধু এই গবেষনা পণ্ডশ্রম জল্পনাই সার ।
বকনা কোথায়? যুবতী কোথায়? অবৈধ কি?
যার ঝিলিমিলি কাঁধ আর কেশর ধরতে পিছু পিছু ঘুরে মরছো ত্রিভূবন।
ভ্রুলতা নাচিয়ে হাসো মেয়েদের মতো,
সবই লিবিডোর খেলা। গুপ্তকাম গহন পাতালে।
সে কি লুকিবিদ্যা জানে? গানে যার ভাঁজ পাই,
তাকে আমি শনাক্ত করবোই। কী বিস্ময়!
কে এক আগুনবতী, মেঘে আলো,পিঁড়ি পেতে বসে আছে । তুমি !
খুব চেনা-চেনা লাগে। কাছে এসো, ভাপ নাও, দীপের উপরে করতলট উপুড়-
পূজা শেষে দিই শান্তি জল তাকাও মুখের দিকে চেনো, প্রকাশেই শান্তি ।
ভূতপ্রেত আসন টলিয়ে দিতে চায়, ভয় না, লোভ না, টলতে দিও না-

বাড়ি যাও, মা আছেন তাঁর যোগ-সলতে জ্বেলে, ঘরের মধ্যেই ।।




ভাঁজ করা ফ্ল্যাট দুজনের
ভাঁজ করা একটাই ঘর; টান দিতে সাজন্ত বেরিয়ে আসে-
বেডরুম। আর একটি টান দাও- গোপন খুপড়ি,
ডানদিকে ; রঙিন টেলিভিশন, হৃদয় চাঞ্চল্যকারী কিছু
স্বহস্তে অঙ্কিত ছবি, সুক্ষ চোখে দেখ ঘোড়াদের কেশের নানান ধাঁচা,
টান দাও- ডাইনিং হলে স্পর্শকাতর কোনটি।
ও হরি্ণ। চারটে তাকে বই ঠাসা, আল মাহমুদের নাম ঝল্কে ওঠে
                                                               এইবার ধীরে
সেখানেই আমি আর চিত্রকর বন্ধু দিবা পাঁচ গতে,
অন্ন আর পেয় নিয়ে চোখোচোখি বসি।
আড়ে প্রায় দেড়হস্ত, দিঘে দিউ, নিচু এক লেখার টেবিলে,
থরে থরে ষোলো পদ, ভোজ বিদ্যা কী ভাবে ধরায়,
অমন সংক্ষেপে এত, ভগবান ! কে এ ভানুমতী।
শেষ প্রস্থে ফলমূল, মিষ্টি, অস্ত যায় বেলা, জানলায় কার ঝিকিমিকি।
(ঠারে হাসো কেন?) দীব্যমান যে দেবতা দূর স্বর্গলোক থেকে
                                                        সমস্ত দেখেন, তাঁকে
সাক্ষী মানি- তিনিই বলুন, দুই গ্লাস পরিষ্কার জল কিনা।)
ঘরনী সে, না অতি ঘরন্তী। সাজো শাড়ি পরে
                                           বড়ি দিতে, কাসন বানাতে, দাও
কে দেখেছে তাঁকে? এমন নারীকে নিয়ে অপূর্ব নির্মানক্ষমা,
গৃহস্থালি নাকি করে! ডিম্বাননা নিপুণা মালিনী,
সূত্রে মণিগনাইব শব্দে শব্দে গাঁথে নর, বহুমূল্য মাথার টায়রা।
সুধা ধবলিম ঘর, সুধা গৃহ, পার হয়ে সরু,
অন্ধকার দরদালান, অবশেষে পৌঁছে যাই সুখোষ্ণ আশ্রয়ে।
আর আমি দিব্যচোখে দেখলাম মানুষ বৎসরে
সুধা দিন আসে, দোর খুলে চমৎকৃত লোকে; মাটির নিচের কক্ষে
                                                           বন্দী দিন কই!
গাছতলায়, পথে, হর্ষধ্বনি, যেখানে যে , লোকসবে,
মাঠে, নদীতীরে, বলছে ; কতযুগে করায়ত্ত করলাম,
মাধ্বী ধেনু; পিঠা আর সুধা।
কথা শুনে বিস্মিত অনেক বন্ধু; একি! জেগেই ঘুমোও কবি-
ক্ষণিকের এ-তুরীয়, এই উচ্চতর অনুভূতি, চেয়ে দেখ। 



অপ্রাসঙ্গিক
জীবনের উৎসব নয় মৃত্যুর ক্ষুধা নিয়ে জেগে আছি আমরা
মাটির বুকে খনিজের মত লুকিয়ে ছিলাম ; সূর্যহীন শান্তি
ভালবাসা নেবার মত প্রসারিত হতে পারে নি বামন, অথবা
দেবার মত তার কিছু নাই বলে ঈশ্বর বলোতো তুমি
হৃদয়ের গর্তে বসে খুনি কার পূজা করে- আসবাবে ভরা
শোবার ঘরে আমার স্ত্রীলোক চেঁচিয়ে ওঠে ঘুমের ঘোরে
গণিকারা বেছে নিয়েছে জীবন তাদের, আমাদের ভালবাসা ছেড়ে।
এখানকার সীমাহীন রাত্রি আমাকে ক্রুদ্ধ করে, নক্ষত্রগুলি
আমারই রক্ত মাংস চায়- কোথায় যে জীবনের চাঁদ সমুদ্রের বুকে
ভেসে থাকে, কখন যে তৃনশস্যলতা আমাকে প্রকৃতি বানায়
পায়ুপ্রদেশ থেকে এক ব্যাথা মাথা পর্যন্ত শিরশির করে আসে
নিজের মুখে হাত দিয়ে হঠাৎই তার আকার পাই না খুঁজে
আমারই সৃষ্ট চরিত্রেরা ঘোরে এখানে আমারই খুনির বেশে
আমারই স্বপ্ন আর মেয়েমানুষেরা ভেজে আমারই শরীরের রসে
চিৎকার শিৎকার মনে হয় আমারই জীবনের উনচল্লিশ খাঁজে
আমাদের সামনে এক প্রভাত হয়েছিল পেছনেও এক প্রভাত আছে
যন্ত্রণার শব্দ শোনা মাত্র চুলের মুঠি ধরে হিঁচড়ে তুলি তাকে
খা, পংক্তি ভোজনের পর যা পড়ে আছে- মরবি এবার তুই
আকাশের বিদ্যুৎ ব্যাহত হয়েছে এ অরণ্যের প্রতি গাছে গাছে
আমার শূন্যতা ভরা শব্দ গুলি অর্থ পায় শিশিরে আর ঘাসে
জীবনের উৎসব নয়- ভয় পরস্পরকে কাছে টেনে আনে
পাত্রটি যেমন ছিল তেমনি আছে কেবল নিজেরই শূন্যের টানে
অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে ; এ ছায়া নাটকে বাস্তব ছিলাম আমি
ধর্ষণকারীর ভালবাসা কিছু বেশি ছিল- জল আজও নিম্নগামী
উন্মুক্ত আমি তাই দুর্বল ; ভালবাসা দেবার সময় লিঙ্গ আর হৃদয়
একই সঙ্গে উত্তেজিত হয়েছিল বলে সহবাসকালেই তাদের গ্রহণ করে,......খায়


পিন ছয় শূন্য
আমবাগান ফেলে যাবো। আরশি নগর ;
কাচঘেরা ঘরদোর- ফেলে , কোথা যাবো?
ঘটের আকার গ্রিল- তুমি ঘট হয়ে থাকো
একশো বছর, ততক্ষণে আমি ছাই।
কাউকে কি কেউ
ঘরে সাঁধ করিয়ে দিলো? একদিন রওনা দেবো-
চকীচকীচকী
বোঁচকাবুঁচকি কিছু নেই, নগ্ন হয়ে যাবো,
এই তীক্ষ্ণ চোখজিভনাক-কিছুই না
আমি যাবো সাত শূন্য শূন্য শূন্য চার শূন্য থেকে
ঘড়িহীন ছয় শূন্য পূর্ণের শহরে।



কৃপা
আমি এক কোণে-
মার খেয়ে পড়ে আছি। সবাই আমাকে
দেখছে আড়চোখে। মুখে দাগ, রক্ত
কপালের শির
নীল হয়ে ফুলে আছে।
                আমি কেন উলটে মার
দিতে পারছি না।  এক-একবার
উঠতে যাচ্ছি। সবাই তক্ষুনি একযোগে
শাবাশ শাবাশ বলছে। আমি ফের
ঘাড় এলিয়ে পড়ে যাচ্ছি। একটু দূরে
স্পষ্ট বন্দুকের কুঁদো-
              আমি ওটা ধরতে চাই,
ধরতে পারছি না, সবাই তক্ষুনি একযোগে
শাবাশ শাবাশ বলছে। আমি জনতার থেকে
আলাদা, প্রায় নিরস্ত্র,
             নদীতীরে পড়ে আছি।
             দূরে খেঁড়ো ঘর
             গোরু জাবনা খাচ্ছে।
আমি একটু জল খেতে চাই-
লাঠিপেটা হরিণের মতো সুমিষ্ট জলের দিকে
বুকের ভর যেতে চাইছি।
             শত্রু
খাড়া বন্দুকটি চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে
আমি তার ট্রাউজার, গামবুট দেখতে পাচ্ছি
            আমার চারদিকে
দর্শকের গুনাগুন। কেউ শিস দিচ্ছে
            কেউ থুতু ফেলছে
            কৃপা.....
আর পারলাম না
গলা ছিঁড়ে তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার
মুঠ করছি। কে হারে
তখন চাষার মেয়ে
                     ভিড় ঠেলে এসে,
হাতে তার খণ্ড বিয়নী
একটা ছুঁইয়ে বলল।
আমি না দেবী, না অপ্সরী, দাও বীর্য
শুল্ক দাও। শত্রু আকাশ থেকে আসেনি
ওটা স্বপ্ন। তাকে খোঁজ । শুধু একটি বার দেখ
আমি কেমন? আমাকে মনে ধরে কি না!

No comments:

Post a Comment