Tuesday 10 April 2018

প্রসূন মজুমদার

গদ্য


              কবিতার দিন - কবিতার রাত্রি
         
  



মিশে আছি। নিরন্তর মিশে মিশে আছি।এই যে কবিতার সঙ্গে নিরন্তর মিশে মিশে থাকা এ আমার আয়ুকে গিলে ফেলতে থাকে ক্রমাগত। স্নায়ুর ভিতরে একটা অভিশাপ চলাচল করতে থাকে যেন।  জীবনানন্দ কি একেই মানে এই অভিশাপকেই 'স্নায়ুর আঁধার ' বলেছেন?এই আঁধার কি সেই অমঙ্গলের দিকে ঢলে পড়ছে, যে অমঙ্গল-চেতনা আমাদের স্মৃতিরও অনেক গভীরে পোঁতা হয়ে যায় নতুন শৈশবেই? না। সম্ভবত না।এই আঁধার, 'অদ্ভুত আঁধার' নয়। এই অন্ধকার সম্ভবত কবিতা-দষ্ট মেধার অভিশপ্ত সমর্পণ, অক্ষরের গর্ভে। 

     এই অভিশপ্ত ভবিতব্য নিয়ে কবিতার ভিতরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার পরে ধীরে ধীরে অস্থির ঢেউ খেতে খেতে এখন শান্ত সমুদ্রের গায়ে নরম হাত ছুঁয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে চুপচাপ।  কিন্তু আমি চাইলেই কি সব সম্ভব!  যত চুপ থাকি না কেন কবিতার দুনিয়ার চাপ, ঠেলে তার ঘূর্ণির ভিতরে টেনে নেয়। অনেক অনেকদিন আগে কবিতা-পাগল এই আমি যখন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলাম হঠাৎ, ঘুরে বেড়িয়েছিলাম গোটা কলেজস্ট্রিট, এক তীব্র গ্রীষ্মের দুপুরে, শুধু উন্মাদের পাঠক্রমের প্রথম সংস্করণটা খুঁজে বার করবো বলে, সেই ঘুরে বেড়ানোর ভিতর যে প্রবল প্যাশন ছিলো,অকারণ প্যাশন, সেই মোহান্ধতা কি অবাস্তব!  আজ এতো দূরত্ব থেকে সেই দিনটার দিকে তাকালে মনে হয় অকারণ বলে কিছু নেই।হতেই পারে তখন জয় গোস্বামীর কবিতা-সংগ্রহ ১  বেরিয়ে গিয়েছে। সেখানে উন্মাদের পাঠক্রম ছিলো। তাহলে কেন প্রথম সংস্করণ দেখার ইচ্ছে হলো আমার? কেন মনে হলো কয়েকটা শব্দ, কয়েকটা যতিচিহ্ন, কয়েকটা বানান ওই প্রথম সংস্করণে কি ছিলো দেখতে হবে! উত্তর পাই নি আজও।তারপর একদিন সেই উন্মাদের পাঠক্রমের কবির কাছে আমায় নিয়ে গেলো বন্ধু শুভ্র। শুরু হলো কবির সঙ্গে আমার সামান্য সাক্ষাৎ। ওই সামান্যর ভিতরেই অনেক অসামান্য পরামর্শ পেয়েছি,পেয়েছি আঘাত।সরে এসেছি। ভয় পেয়েছি যেকোনো কবির সঙ্গে কথা বলতে। একা থাকাই আমার অভ্যাস।আরো একা করে তুলেছি নিজেকে।প্রায় দশ বছর(২০০২-২০১২) নিজের লেখা ছাপাতে দিই নি কোথাও।ভেবে রেখেছি নিজের স্বর যদি না খুঁজে পাই, তাহলে লেখা ছাপাতে দিয়ে লাভ নেই।ভেবেছি কি হবে কবিতার বিষয়? যা লেখা হয়ে গেছে তাকেই নতুন করে লিখে লাভ কী?

   কেউ কেউ দেখি বলছেন, যা লেখার তার সমস্তই কবিতায় লেখা হয়ে গেছে। বলার ধরণটাই স্বকীয়তা। আবার কেউ কেউ বলছেন বিষয় নিত্য জায়মান।  সেক্ষেত্রে ফর্ম আর কনটেন্ট সবই নতুন হয়ে উঠতে পারে। আমি ভাবি।ভাবতে ভাবতে যাই। শুধু বিষয় আর আঙ্গিক!  এটুকুতেই আটকে যাবে কবিতা?বিষয় থাকতেই হবে কবিতার?  বিষয়হীনতার দিকে যেতে পারবে না সে?থাকতেই হবে একটা কনক্রিট ফর্ম? এইসব ভাবি।ভাবতে ভাবতে পড়তে থাকি অন্যের ভাবনা।এই তো এক কবি লিখেছেন, কবিতা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক প্রবল অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।সে পারে বলেই হয়তো রাষ্ট্র প্রচার করেছিলো প্লাতোর ভাবনা।যেখানে প্লাতো তাঁর আদর্শ  রাষ্ট্র থেকে দূর করে দিতে চেয়েছিলেন কবিদের। হয়তো তাই।কিন্তু কবির কাজ কি শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ?সে তো বিপ্লবীরাই করতে পারে? হ্যাঁ কবি করলে একটু ভালো হয়।ছন্দে, সুরে গাঁথা প্রতিবাদের বাণী গণমনে
দ্রুত ছড়িয়ে যায় বলেই কি প্রতিবাদী কবিকে ভয় করে রাষ্ট্র? তবে তো কবির কাজ অত্যন্ত গম্ভীর। সমাজ - পরিবর্তনের বার্তাবাহী অনুঘটক সে। কিন্তু সত্যি এই স্লোগান লেখাই কি কবির কাজ? স্নায়ুর আঁধারের কথা তবে কি করে এলো? এই সমাজ -পরিবর্তন, বিপ্লবের বার্তা, এইসবের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার দারুণ সুযোগ লুকিয়ে থাকে অবশ্যই আর কিছু কিছু মানুষকে জনপ্রিয়তার মোহ এতটাই তাড়িত করে যে তারা নিজের অজান্তেই নিজেকে বুঝিয়ে ফেলে স্লোগানই কবিতা।সে কবিতার পথকে আক্রমণ করা আমার উদ্দেশ্য নয় কখনওই। তবু আমি কবিতাকে অন্যত্র খুঁজেছি।কেন? আমি কি চাই না সমাজ পাল্টাক? চাই তো।কবিতা লিখে সমাজ পালটানো গেলে সে তো ভালোই। কিন্তু আমার নিজের চেতনায় কোনো পরিবর্তন এলো না আর সমাজ পালটে গেলো, এটা কি হওয়া সম্ভব?এই পরিবর্তনটা কি কেবলই একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন - মাত্র নয়? একটা দেশ আর একটা দেশের উপর শাসন চালাচ্ছিল।দূরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো কবির কলম।শুধু সেই কলমের খোঁচাতেই বিদেশী শাসক দেশ ছাড়লো। ব্যাস।কবির কাজ শেষ?  এই যে চলমান সভ্যতা, তার চেতনে যে জড়ত্ব তার কি হবে? তবে?সমাজ-মনস্কতা। এটাই কি কবির দায় শুধু? মানে এই ধরুন কবি লিখলেন,'ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও/আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক'। কবি চিহ্নিত হলেন সমাজের বিবেক হিসেবে।মানে সমাজের কলুষ তিনি মুক্ত করার কথা বলেন।তাহলে তিনি তো খুব দরকারি কাজ করছেন। তাঁর ছন্দে কিম্বা কাব্যিক দ্যুতিতে তিনি সমাজ-সংস্কারের কাজ করছেন।এটাও খুব হাততালি পাবার ব্যাপার।কিন্তু ভাবি,কাক কিম্বা কুকুরও তো সমাজ পরিষ্কার করে। তারা কি কবির সম্মান পাবার যোগ্য! যখন ভাগাড়ের মরা গরুর ওপর অজস্র শকুন নেমে আসে।তখন তাদের দীর্ঘক্ষণের আকাশ- পর্যবেক্ষণের দিকে তাকিয়ে দেখেছি কী অপরূপ আর সাবলীল ছন্দে নেমে আসছে তারা মরা গোরু কিম্বা ষাঁড়ের ওপর।ছন্দে পরিষ্কার করছে সমাজ।
এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কেউ কেউ হইহই করে উঠবে।তাদের মনে হবে আমি শঙখ ঘোষকে শকুন বললাম।তাদের বলি,আমি শঙখ বাবুকে শকুন বলি নি।শঙখবাবুর লেখা আমাকে মুগ্ধ করে।ওনার ক্রাফটকে হ্যাটস অফ করবে না এমন কেউ আছে না কি! আমি আসলে মনে মনে বারবার প্রশ্ন তুলেছি 'সমাজ-শোধনের কবিতা' এই ভাবনাটার দিকে। কবিতার কাজ কি সমাজ-শোধন করা? আচ্ছা,বিজ্ঞানীর কাজ কী? তিনি কি সমাজকে আরামে,শান্তিতে রাখার জন্য রিসার্চ করে চলেন? লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে স্টিফেন হকিং পর্যন্ত যে বিজ্ঞানীরা তাঁদের আবিষ্কারের জন্যে বিশ্ববিখ্যাত হলেন তাঁদের কোন গবেষণা  সামাজিক শুভ বোধকে উস্কে দেওয়ার কাজ করেছে? কবে কোথায় তাঁদের কাজ সমাজ -পরিবর্তনের অস্ত্র হয়ে উঠেছে?এক্ষেত্রে একটা কথা মনে হলো প্রায় দশ বছর বাংলা কবিতা-লিখিয়েদের সমাজকে এড়িয়ে চলার পর  কাকতালীয় ভাবে ২০১২ তে দেশ পত্রিকায় আমার একটা দীর্ঘ লেখা ছাপা হয় কবিতার পাতায়।সেই লেখাটা যে রাতে লিখেছিলাম তার পরের দিনই আত্মহননের চেষ্টা করেছিলাম, লেখার জন্যে না,লেখাটা যে জন্যে এসেছিল সেই কারণে।শেষ - পর্যন্ত আত্মহত্যায় ব্যর্থ হবার পর আমি বুঝি যে একমাত্র লেখাই আমায় বাঁচিয়ে রাখতে পারে।আবার আমি ঢুকে পড়তে থাকি বাংলা-কবিতাবাজির দুনিয়ায়।মনে হয় কবিতার এই দুনিয়াটা দশ বছরেও এতোটুকু বদলায়নি। যাই হোক সেসব নিয়ে আলোচনা করতে ভালো লাগছে না,ভালো লাগেও না। তবে এই কয়েক বছর হলো দেখতে পাচ্ছি একদল লোক,মানে কবিতা-কেন্দ্রিক একদল লোক প্রচার করছে কবি হতে গেলে ভালোমানুষ হতে হবে।এই প্রচারের সামনে পড়ে প্রথমটা থতমত খেয়ে যাই। কী বলতে চায় এরা? এরা কি র‍্যাঁবো,বোদলেয়ার মায় মধুসূদন, শক্তি-সহ প্রায় সব ভাষার বলিষ্ঠ আর কিংবদন্তি - প্রতীম কবিদের কবি বলেই মনে করে না! নাকি এদের প্রত্যেককেই সামাজিকভাবে ভালোমানুষ মনে করে? সামাজিকভাবে ভালোমানুষটা কে? ভালোমানুষের একটা সমাজস্বীকৃত চেহারা কল্পনার চেষ্টা করি,  তারপর আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ভয় পেয়ে যাই। কী ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে রূপ আমার।সামাজিকতা যাকে যাকে ভালো বলেছে তার কোন গুণই তো নেই আমার।তবে? ভাবতে ভাবতেই আশ্চর্য সমাপতনে পাশে কোথাও থেকে ভেসে আসে গান, ' ভালোমানুষ নই রে মোরা, ভালোমানুষ নই'। ওই, ওই জায়গাটা ' আমাদের আর নাই রে গতি, ভেসেই চলা বই'। যে - সমস্ত প্রিয় কবিতা - মনস্ক ব্যক্তি এই ভালোমানুষ >কবি-এর তত্ত্ব  আওড়াচ্ছেন তাঁরা কি তবে এই গান কেউ শোনেন নি? ভাবতে থাকি।দিন যায়, আর আমি বুঝতে পারি আসলে কবিতা-বৃত্তের বেশিরভাগ অংশটাই কবিতা লিখতে/পড়তে/ভাবতে আসে না।তারা চায় খ্যাতি। যদি তারা গান গাইতে পারতো তাহলে কবিতা না লিখে অবশ্যই গান গাইতো।আমার এই ভাবনার সমর্থন পাবেন,যদি দেখেন যে বাঙালি আগে কৈশোরে কবিতা লিখতো,সেই বাঙালি কৈশোরের কাঁধে এখন হাওয়াইয়ান গিটার।কেন?চারপাশকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য যে 'আমি গান গাই'।   জনপ্রিয়তার কাঙ্ক্ষা যাদের  চালিত করে তারা কবিতা লেখার থেকে ভালোমানুষ হওয়াকে এগিয়ে রাখতে চায়।এই প্রচার তাদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা দেয়।সমাজ তাদের লেখায় হাততালি দেয়।সমাজ হাততালি দিলে সমাজ-চালক রাষ্ট্র তাদের সম্মান দেয়,পুরস্কৃত করে।তাদের অর্থ আর খ্যাতি হয়। কবিতা হয় কি? কেউ বলবেন কেন হয় না?তুমি খ্যাতি পাও নি বলেই এইসব বলছো। 'কেন হয় না'-র উত্তরটা নিয়েই ভাবি।আর ভাবি ভাগ্যিস খ্যাতি পাই নি,তাই তো ভাবতে পাচ্ছি।নাহলে পুরো ভাবনাটাই তো নিয়ন্ত্রণ করতো সমাজ। 

     সত্যিই কি কবিকে ভালোমানুষ হতেই হবে? চলুন এটা নিয়ে একটু ভাবনা-চিন্তা করি।যে কবিতার মানুষেরা মনে করেন কবিকে নিজের লেখার কাছে সৎ হতে হবে,তাঁরা যদি ভালোমানুষ-এর তত্ত্বকে সমর্থন করেন তবে তাঁরা বলতে চাইছেন যে ভালো একজন মানুষ হলে তবেই তাঁর লেখায় তিনি সৎভাবে ভালো হবার কথা লিখবেন।এই ভাবনাটার ভেতরে আসলে লুকিয়ে আছে যে ভাবনাটা সেটা হলো, কবিতা সেগুলোই যেগুলো সমাজ-শোধনের কথা বলে।এই আবার শকুনের প্রসঙ্গ।আচ্ছা ধরা যাক, কবিতা শুধুই সমাজকে ভালো করার কথা বলবে।সেক্ষেত্রে সমাজের খারাপ দিকগুলোকে দূর করার কথা কবিকে লিখতে হবে।খারাপ দিকগুলো কি? তার ধরণ,প্রকার আর কারণ না জানলে তাকে উৎখাত করা যাবে? যাবে না। এখন কবিকে যদি সমাজের খারাপ দিকটার আদ্যোপান্ত জানতে হয় তবে খবরের কাগজ পড়লেই জানা যাবে? তাকে সেই খারাপ জীবনটার কষ্টটা পেতে হবে না? যদি কবি সেই খারাপ জীবনটা শুধু টি,ভি দেখে,গুগুল ঘেঁটে আর খবর পড়ে জেনে ফেলবেন মনে করেন,তবে যখন তিনি তাঁর  চোখে দেখা বলে কবিতায় লিখবেন,তিনি কি তাঁর লেখার কাছে পুরোপুরি সৎ, এটা বলা যাবে?রিলকে তাঁর তরুণ কবিকে লেখা পত্রে বললেন কবি হতে গেলে এমনকি একটি ফুলের ফুটে ওঠারও সাক্ষী  থাকতে হবে।এই কথাটা যদি আমরা আপ্তবাক্য হিসেবে ধরে নিই( ধরে নেওয়াটা কর্তব্য বলেই অন্তত আমি মনে করি) তাহলে এটাও ধরে নিতে হবে যে শুধু ফুলের প্রস্ফুটন না, ছাই ঘেঁটে পাপ ছিল কিনা সেটাও দেখে নিতে হবে।তাহলে কবি সেই পাপের সামনে না দাঁড়ালে,আগুনের ভিতরে না পুড়লে কিভাবে হয়ে উঠবে ভূয়োদর্শী? হ্যাঁ ভূয়োদর্শন। র‍্যাঁবোর এই ভাবনাটার প্রতি গভীর সমর্থন আমার। এখন প্রশ্ন হলো ভালো আর পাপ এই দুটো শব্দ যে আমি ব্যবহার করলাম, দুটো শব্দই কি ভীষণ আপেক্ষিক না? যে কবিতা লিখতে এসেছে সে আপেক্ষিকতার উপরে যদি নির্ভর করে বসে তবে কিভাবে সে তার কবিতা লিখবে।এইসব ভাবতে ভাবতে মনে হয় আসলে ভালো-মন্দের আপেক্ষিকতাতে এরা বিশ্বাস করে না,এদের কাছে ভালো - মন্দের একটা নির্দিষ্ট সমাজস্বীকৃত আদল রয়েছে। সেই আদলকে যে মেনে নিলো, সে কিভাবে নতুনের প্রত্যাশা করবে? করেও না সে।সে কারিকুরির মাধ্যমে সমাজের চেনা ও চর্চিত কথাগুলোকে একটু সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে হাততালি পায়।এরা কি কবিতাকে বিপদে ফেলে দেয়?আমি তা মনে করি না।আসলে সমাজের একদল লোক মনে করে শিল্প আমাদের আদর্শবোধ শেখায় এবং সেই আদর্শটা সমাজের মানুষের ঘোষিত আদর্শ।  এই যেমন ধরুন একটা গানের কথা 'তোমার ঠিকানা আজ বৃদ্ধাশ্রম '। এই গানে বলছে বৃদ্ধ মানুষদের কষ্ট। বৃদ্ধদের একাকিত্ব, সন্তানদের থেকে তাদের দূরত্ব এইসব ক্ষেত্রে সন্তানদের মোগাম্বো বানিয়ে এই গান। গানের শেষে সন্তানদের প্রতি আছে শ্লেষ। তারাও বুড়ো হলে বৃদ্ধাশ্রমে যাবে মনে করিয়ে প্রতিশোধের তীব্র প্রশান্তি বাবা- মা -এর।গান হিট।ঘরে ঘরে গান বাজছে।কারণ?  সমাজকে গানটা ছুঁতে পেরেছে। সমাজকে তুমি যদি কান ধরে উঠবোস করাতে চাও তাহলেও জনপ্রিয় কারণ সমাজকে ছুঁয়ে আছো।এই রকম একটা বৃত্তে ভালোমানুষ কবির তত্ত্ব এসে পড়ে।আর এটা আমাকে রীতিমতো বিরক্ত করতে থাকে। কবিতা লিখতে এসে কেবল সমাজ,সামাজিক অস্থিরতা,সামাজিক ন্যায়বোধ এই নিয়ে যদি একজন  চিন্তিত হয়ে পড়ে তবে তার উচ্চকিত উচ্চারণ আমার হয়ে ওঠে না কোনোভাবেই। 

  আমি মানি না কবিকে হতে হবে ভালোমানুষ। বরং আমার মনে হয় ভালোমানুষের পক্ষে কবি হয়ে ওঠা অসম্ভব। কবিকে হতেই হবে ভূয়োদর্শী।আর জীবনেতিহাসের নানা ভাঁজের রেখাগুলো দেখে নিতে গেলে,রেখার গভীরতায় আটকে থাকা ময়লাটাও দেখে নিতে হবেই।হাঙরের ঢেউএ লুটোপুটি খেতে হবে তাকে। যাপনকে করে তুলতে হবে অসামাজিক।আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে গুষ্টিসুখ উপভোগ করবো আবার কবিও হয়ে উঠবো, এ সম্ভব নয়। যাপন যাকে বর্ণময় করে নি সে কিভাবে কবির রঙিন দৃষ্টি নিয়ে দেখবে তার সময়কে,সময়ের আগের চলাচল কিম্বা ভবিষ্যৎ-এর ভেলাগুলোকে।সম্ভব না।একটা ছন্দোবদ্ধ গল্প লেখার ধরণ বহুদিন ধরেই বাংলা কবিতার ধারায় গুঁজে দেওয়া হয়েছে।মধ্যযুগীয় কাব্যগঠন থেকে চেঁছে নেওয়া এই ধরণটা খুবই জনপ্রিয়। কারণ বাঙালি গল্প শুনতে ভালোবাসে।তাই ছন্দ -অলঙ্কারে গাঁথা এইসব গল্প  লিখে রবীন্দ্রনাথ থেকে জয় গোস্বামী অবধি বাঙালি কবি প্রচুর খ্যাতি পেয়ে এসেছেন।ভাবুন তো বাংলা ভাষার একটা জনপ্রিয় কবিতার লাইন ---'তাহার দুটি লালন করা ভেড়া/চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে/যদি ভাঙে আমার ক্ষেতের বেড়া /কোলের পরে নিই তাহারে তুলে '।ভাবা যায়!  আচ্ছা সেই একই গল্পের ধারা ধরেই কি লেখা হয় নি, ' আমি তখন নবম শ্রেণি, আমি তখন শাড়ি/ আলাপ হল বেণীমাধব সুলেখাদের বাড়ি।'?রবীন্দ্রনাথের 'এক গাঁয়ে' লেখাটা কবিতার মর্যাদা পেয়ে এসেছে বছরের পর বছর, এখন যেমন পাচ্ছে বেণীমাধব।যে কবির একটা উন্মাদের পাঠক্রম আছে, জনপ্রিয়তার জন্য, শুধু জনপ্রিয়তার জন্য তাকে লিখতে হয় 'মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়'।আর তখনি তার কবিমুকুট খসে পড়ে সবার অলক্ষে। এই গল্পের পথ কবিতা না।তবে কোথায় খুঁজবো সেই কবিকে?  ভাবতে ভাবতে একসময় মনে হয় অন্য স্বরে হয়তো পাওয়া যাবে ঈপ্সিত কবিত্ব।এই ভিন্নস্বরের উদগাতাদের মধ্যেও একধরণের শঙখীয় ধর্মযাজক - বৃত্তি দেখেছি। হ্যাঁ খুব ভেবেই বললাম কথাটা।  কবি নিজেই যখন হয়ে ওঠেন প্রতিষ্ঠান, যখন তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় স্তাবক বা এই আমার মতো সমালোচকদের ভিড় তখন সন্দেহাতীতভাবে তিনি একজন অতি-সামাজিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।যতই তিনি নিজেকে 'সামাজিক নই' বলুন না কেন, রবিবারের সকাল জানান দেয় তিনি শুধু সামাজিক না,একটি বিশেষ সামাজিকতার নিয়ন্তা।  এটাই কি সাফল্য? এই তো সেদিন জয় গোস্বামীর কবিতা - গদ্য পাঠের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম।তিনি বললেন তাঁর গদ্যে তিনি সেইসব মানুষের কথা লিখেছেন, যারা ব্যর্থ--- যারা রিলকে না,র‍্যাঁবো না,এমনকি রবীন্দ্রনাথ বা শঙখ ঘোষও না তারাই কবির মতে ব্যর্থ।শুনতে শুনতে মনে হলো কবি সাফল্য মাপছেন জনপ্রিয়তা দিয়ে। এটাই কি একজন কবির কাছে সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা না?যে কবি নিজেকে সামাজিক সাফল্যের দাঁড়িপাল্লায় মাপেন তিনি তো নিজেই আটকে পড়লেন।কিভাবে তিনি হয়ে উঠবেন ভূয়োদর্শী?

কবি কি জনপ্রিয় হবেন? অথবা কবি কি জনপ্রিয় হবেনই না? এইসব প্রশ্ন এসে পড়লো এবার। জনপ্রিয় হলেই তাঁকে সফল কবি বলা হবে,এই ধারণা বাস্তবিক  অসম্পূর্ণ। কারণ একজন কবি কেবল তাঁর সময়ের সামাজিক আলো - অন্ধকারকে ধরে রাখলে তিনি ছোট্ট এক কালখণ্ডে আটকে পড়লেন।তাহলে?  কবি বলতে আমরা যদি মনে করি সময়ের বা সমাজের জাগ্রত বিবেক তবে সেই ভাবনা যে ভুল এটা বলতে পারি না। মানে চৈতন্যের সাধ্য-সাধন তত্ত্ব - আলোচনার মতো মনে করতে ইচ্ছে হয়,এও হয়।কিন্তু আগে আরো যাওয়া যায়। মানে আমি বলতে চাইছি,যে কবিতার ফর্মে কেবল ক্রাফট দেখালো, ভাবালো না নতুন  কিছুই, তাকে কবি  বলতে পারবো না,বরং বলবো, 'এহ বাহ্য'। কিন্তু কারুকলা- মন্ডিত অর্থাৎ ছন্দ,অলঙ্কারে চোস্ত যে কাব্যিক টেক্সট তার ক্ষেত্রে যদি দেখি কোনো অন্তর্দৃষ্টির সামান্য নতুন, নিজস্ব গভীরতা রয়েছে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে বলবো এও হয়।কিন্তু কবি হয়ে উঠতে গেলে আরো আগে যেতে হবে।এই আগে যাওয়ার পথটা কাঁটা-বিছানো একার পথ।পর্তুগিজ কবিতার আধুনিকতার জনক ছিলেন ফের্নান্দো পেশোয়া। তিনি লিখছেন,' যদি তুমি একা হতে না পারো তবে জানবে ক্রীতদাস হয়ে জন্মেছ। ' এটা তিনি যত না সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্যে বলেছেন,তার থেকে অনেক বেশি বলেছেন,কবিদের জন্যে। কবিকে হতেই হবে একা? কতো কবিই তো দল গড়েছেন।চিৎকার করে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।তাহলে? আসলে কবিতা - আন্দোলনের সরব হইচই-এর মধ্যে থাকতেই পারেন কবি।কিন্তু দলে যে থাকে সে আসলে কবির বাইরের লোকটা।সেই বাইরের লোকটা কিন্তু কবি নয়।সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে যিনি কবি, এই যেমন হ্যেল্ডার্লিন কিম্বা জীবনানন্দ, এরা কি কখনো কবিতা- আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠতে পারবেন? পারবেন না। যে কবিরা আন্দোলন করে নতুন কথা বা নতুনভাবে কথা বলতে চান তাঁদের কি কবি বলতে নারাজ আমি?  একেবারেই না।তাঁরাও কবি কিন্তু 'এও হয়'- এর ধরণের কবি। আগে আরো যেতে হলে কবিকে নিঃসঙ্গ হতেই হবে।কারণ কোনো নির্দিষ্ট কালখন্ড কবিকে আটকে রাখতে পারে না। কবিকে হতেই হবে দ্রষ্টা।  জ্ঞানের জগত থেকে এগিয়ে যেতে হবে প্রজ্ঞার আবহে। প্রাজ্ঞ হয়ে উঠতেই হবে তাঁকে।জ্ঞানপূর্ণ প্রজ্ঞা যদি লাভ করতে হয় তবে শুধু মলয় - বাতাসে ভেসে গিয়ে কুসুমের মধু পান করলেই চলবে না তার। তাকে কাটিয়ে আসতেই হবে নরকে এক ঋতু। প্রিয় ফুল খেলবার দিনগুলোকে যেমন উপভোগ করবে সে তেমনি গোখুরের ছোবলে নীল হয়ে যাওয়ার কষ্টকে পেরোতে হবে একা। এই নির্জনতার কথাও বারবার বলতে বলতে অনেক ক্ষেত্রেই অবশ্য ব্যাপারটা গুলিয়ে গিয়েছে।জীবনানন্দ নির্জনে ছিলেন অতএব মরণানন্দও নির্জনে কাটালেন, মনে মনে ভেবে বসলেন তিনিও কবি। এই কাণ্ড কবিতার দুনিয়ায় ক্রমাগত ঘটতে থাকে বলে মুড়ি- মিছরি গুলিয়ে যায়। কিভাবে কবি নির্জন হবেন সে তাঁর নিজস্বতার বিষয়।এটা না বুঝলে খুব মুস্কিল যে, বিনয় মজুমদার তাঁর মতো করে নির্জন আবার শক্তি 'অনেকের মধ্যে একা'।এই একা হতে পারার সাহসের মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে সম্পূর্ণ নিজস্বতাকে কবিতার শরীরে ঢেলে দেবার স্পর্ধা।  স্পর্ধা বললাম, কারণ যে কবি তার একার নিজস্বতায় নতুন অক্ষর-বৃত্ত তৈরি করছে তাকে মেনে নিতে হবে অখ্যাতির বেদনা।যে কবি নতুন স্বর নিয়ে আসছেন,যিনি দেখতে পাচ্ছেন অনেক পরের সময়কে তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে তাকে অবশ্যই পেতে হবে উপেক্ষা।এবং এই উপেক্ষার চাবুক শরীরে নিয়েও হতাশ হলে তার চলবে না।সে তো হতাশা লিখতে আসে নি।সে তো আবিষ্কার করতে এসেছে।ঠিক যে  নির্লিপ্তিতে একজন বিজ্ঞানী চালিয়ে যান তাঁর গবেষণা, সেই নির্লিপ্ত সাধনায় কবিকে খোঁজ করতে হবে সারসত্যকে।জগত ও জীবনের সারকে উপলব্ধি করার জন্য তার কাছে কোনো যন্ত্র নেই। তার আছে মেধা আর মনন।এই তার সম্বল।না, আর আছে অভিজ্ঞতা।এরাই কবিকে দেবে অভিজ্ঞান।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো?ব্যাপারটা আমার কাছে যেভাবে এসেছে তা হলো---

১) ছন্দ-অলঙ্কার চটুল অদরকারি বা পুনর্কথন-দোষে দুষ্ট কবিতার মতো টেক্সটের ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই, 'এহ বাহ্য'।আগে যেতে হবে।'আমাদের যেতে হবে দূর বহুদূরে।  যেতে হবে'।
২) উচ্চকিত স্বরের যে কবিতার মতো টেক্সট  আর্থ-সামাজিক,রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে লেখা হয়।তার ক্ষেত্রেও বলি, 'এহ বাহ্য'।আগে যেতে হবে।'আমাদের যেতে হবে দূর বহুদূরে।  যেতে হবে'।
৩) যে পঙক্তি পাঠক- মনকে চমৎকৃত করে,ক্ষণিকের মুগ্ধতা সৃষ্টি করে মিলিয়ে যায় তার ক্ষেত্রেও, 'এহ বাহ্য'।আগে যেতে হবে।'আমাদের যেতে হবে দূর বহুদূরে।  যেতে হবে'।
৪) যে লেখা নতুন কিছু ভাবায় ঠিকই কিন্তু কবিতার আঙ্গিকগত ব্যাকরণ না জানার ফলে থেচকে যায়, সে কবিতা হতে পারে না।
৫) যে লেখা  কবিতা - আঙ্গিকে সমৃদ্ধ হয়েও নিছক কাল / স্থানের নির্দিষ্ট অঞ্চলে আটকে পড়ে,তার ক্ষেত্রেও, ' এহ বাহ্য'।আগে যেতে হবে।'আমাদের যেতে হবে দূর বহুদূরে।  যেতে হবে'।
৬) যে লেখা তার চামর দুলিয়ে/ঠাস করে থাপ্পড় মেরে অদেখা বাস্তবের সামনে আমাদের দাঁড় করায়,যদি সেই লেখা কবিতাদেহের কৃৎকৌশলকে ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করতে পারে তবে সেই লেখাকে কবিতা বলার ক্ষেত্রে আমার সমর্থনের হাত তুললাম।কিন্তু এটা অনেকটা 'এও হয়, আগে কহ আর' -এর মতো ব্যাপার।অর্থাৎ, প্রকৃত কবিতা রয়েছে আরো দূরে।
৭)  যে লেখা পাঠের পরে কয়েক-মিনিট অভিভূত, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয় সে লেখা তো কবিতা বটেই।তবুও আমার নিজস্ব ভাবনায় এটাও অনেকটা 'এও হয়, আগে কহ আর' -এর মতো ব্যাপার।অর্থাৎ, প্রকৃত কবিতা রয়েছে আরো দূরে।

    এইবার আমার ভাবনা-বৃত্তের পরিধি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ওই যে বললাম মিশে থাকা।সেই মিশে থাকতে থাকতে আমি কবিতাকে দেখতে পাই ভোরের কুয়াশার ধূসর অস্বচ্ছের ওপারে। সে চুপ।নিস্তব্ধতার অপেক্ষায় বসে থাকে।মনে হয় চুপ করি।শব্দহীন হই।এই উপদেশটা দেওয়ার জন্যে আমি শঙখবাবুর কাছে ঋণী।  তিনি কবি। তিনি তার থেকে বেশি সম্ভবত আশ্রয় তাদের যারা প্রকৃত কবিতাকে খুঁজতে চায় রহস্য-নদীর অন্যপারে। 

    তাহলে কবিতার সুদূরের অভিযাত্রা কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের? ভাবতে থাকি আর মনে পড়ে হ্যেল্ডার্লিনের কথা। কবিতায় একটা যতিচিহ্ন তাকে ভাবনায় গভীর আকুল করে দেয়। তিনি পেরিয়ে যান অনেকপথ শুধু  ওই যতিচিহ্নের খোঁজ নিতে। এই সেদিন পড়ছিলাম, কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের এক সাক্ষাৎকার। সেখানে তিনি বলছেন 'একবার মনে হলো একটা কবিতাকে ধরতে পারবো, নগ্ন হয়ে,তখন নগ্ন হয়েই সেই কবিতাকে ধরলাম।' এটা শুনে বাংলা -কবিতা সমাজের অনেক গরিষ্ঠ, জনপ্রিয় কবিকে একবাক্যে বলতে দেখেছি পার্থপ্রতিম অমন গিমিকে বিশ্বাস করেন। গিমিক! হতেও পারে। কিন্তু যদি না হয়! ভাবতে থাকি কবিতাকে খোঁজার এই নিবিড় সাধনা যদি নিয়ে যায়  কবিকে দূর? যদি তাঁর  চেতনাকে দূর-সঞ্চারিত করে তিনি কবিতার অবয়বকে  ছুঁয়ে ফেলতে চান? রামকৃষ্ণ যেমন দাবি করেছিলেন,তিনি দেখতে পেয়েছেন, তাঁর সাধ্যকে, যদি কোনো কবি দেখতে পান তাঁর সাধ্যকে? ভেবে যাই। ভাবতে ভাবতে যাই।  কতদূর কবিতার অভিযাত্রা? কেবলই কি সমাজ,রাষ্ট্র,বাস্তবতা, আর জীবনের আঁকেবাঁকে থাকা শিরায়, উপশিরায় খুঁজবো কবিতাকে? কবিতাও কি শুধু চেনা জগতের অচেনাকে দেখিয়ে দিয়েই থেমে যাবে? চমকিত করা কিম্বা বস্তুগত জগতকে উলটে দেখিয়ে দেওয়াই কি তার কাজ শুধু? মনে হয়, এই সবই হয়,কিন্তু আগে আরো কিছু আছে।কবিকে হতেই হবে সেই দূরবিস্তৃত জগতের দ্রষ্টা। যা কিছু নেই,  না-ই বা হল সব পাওয়া,বলে কবি প্রেমের সাধনায় না পাওয়ার রঙ ঢেলে থেমে যাবেন?  যা কিছু নেই তা কি সত্যিই নেই নাকি অন্য কোথাও আছে জানতে চাইবেন না কবি? কবি কি যা কিছু নেই, সেই অনন্ত শূন্যের সাধনা করবেন না? আমার মনে হয় কবির সত্যিকারের সাধনা আসলে ওই অনন্ত শূন্যের সাধনা। শব্দ দিয়ে নৈঃশব্দ্যকে ধরার সাধনা। জ্ঞানের অন্ধকারকে প্রজ্ঞা দিয়ে আলোকিত করার দিকেই কবির অভিযাত্রা। কবিতার আঙ্গিক ব্যবহার করেন বলেই তিনি কবি।নাহলে তিনি হতেন দার্শনিক। দর্শনের আঙ্গিক ব্যবহার করেন তাই তিনি দ্রষ্টা। নাহলে তিনি হতেন দেবদূত। দেবদূত লিখেই মনে পড়লো রিলকের সেই লাইনটা--- 'কে? আমি চিৎকার করে উঠি যদি হবে শ্রোতা সমবেত ওই দেবদূত-বৃন্দের মধ্য থেকে'। হ্যাঁ।রিলকে পাঠককেও দেবদূতের মর্যাদা দিয়েছিলেন। পাঠককেও কখনো কখনো কবির মর্যাদা দিতে ইচ্ছে করে আমার।যখন সুদূর-পিয়াসী কোনো কবিতার অভিযাত্রা পাঠক তাঁর মেধা দিয়ে ছুঁয়ে ফেলেন, কবিতার নৈঃশব্দ্য ছুঁয়ে ফেলতে পারেন শব্দের চাদর সরিয়ে তখন পাঠক খুঁজে পাবেনই সেই অরূপের রূপ।তিনিও হয়ে উঠবেন কবি।সেই অনন্ত শূন্যের নিঃসীমতার রহস্যকে অক্ষরে,ছন্দে,ছন্দহীনতায় বিছিয়ে দিতে দিতে কবির চলাচল।সেই স্বল্প-পরিচিত কুয়াশাচ্ছন্ন পথই কবির চলার পথ।  এইসব ভাবতে ভাবতে অতিধীর কচ্ছপগতির এই যাত্রা আমার,ছুঁয়ে থাকা,মিশে থাকা,মিশে মিশে থাকা কবিতায়।

No comments:

Post a Comment