Wednesday 11 April 2018

ফিরে পড়া কবিতা- কবি তুষার চৌধুরী


পক্ষীপুরাণ

শান্তিচুক্তির চেয়ে বিচক্ষণ ডিগবাজি খেয়েছি আমি
হে কুশলী পাখি
সমুদ্রের দেশ থেকে নিয়ে এসেছি সাঁতারু বাতাস
জলযানের নাভি
তোমাকে খুঁজেছি আমি ইঞ্জিনের ঘুমন্ত শীৎকার থেকে ভেসে ওঠা
জ্যামিতিক ফেনরেখা
অন্ধকুবলয় উড্ডীন বোমারু হে পাখি
সাতকাহন কুৎসা গেয়েছি ভালোবাসার নামে
ডানাকাটা পরীদের হে কেয়োকার্পিন
বড় গোপন তোমার লোভলালসা জেনেছি রাত্রির চুলে
প্রাপ্তবয়স্ক পালঙ্ক আমি ব্যবহার করেছি অনেক
পচা মাংস ঠুকরে খেয়েছি বিষ মেশানো হৃদয়
চিৎবিকার হ’লো না খুন হ’লো না মদের বিশাল পিপেও
লালপদ্মের ওপর বাবার পা
মায়ের নাইকুণ্ডলের ফুল উড়ে আসে ঘুমন্ত তুলোবীজ
হে বাবুই তুমি জমা করেছ সোনালি রোদ্দুরের আঁশ
আমি বুঝেছি কুমারীদের ইঙ্গিত
ঐ যাদুলাস্যে গেছি কুয়াশায় পার্কে বাগানে
সিনেমায় যাদুঘরে ফুলের বাজারে কবিতায়
হাবা চন্দনার সাথে জলের কাছেও গেছি
উদাসী ছেলের মতো পথেঘাটে শুঁকেছি পেট্রল
শেষটায় খেয়েছি চেটে এ-ওর মুখের লালা
এভাবে জেনেছি মাংস ও দাঁতের মেলামেশা

হে পাখি কিছুই চাই না
পিঁপড়ের আস্তানার মতো ছিদ্রটিদ্র হলেই চলে যায়
পুতুলরমণী চাই টয়লেটে পেপার চাই
কিছুই চাই না আর প্যারাম্বুলেটরে শুয়ে ঘুরতে ফিরতে চাই
চুষিবোতলের মধ্যে দুধ ও কবিতা চাই
হে পাখি উনুনে
তোমাকেও খেতে চাই সেঁকে…



আত্মগোপন


শবের বিষয়ে লিখে লাভ নেই, গণিকা বিষয়ে
মদ ও ইঁদুর নিয়ে, শুঁড়িপথ নিয়ে বড়ো বেশি
লেখা হয়ে গেছে, হিংস্র অশ্বারোহীদের নিয়ে খুব
নিন্দামন্দ হল, কত স্বর্গলাভ হল আত্মঘাতে
আমাদের মতো যারা পাতালপুরীতে আত্মগোপন করেছে
পালঙ্কে গড়ায় তারা অতীত রূপসীদের দেহ আঁকড়ে ধরে
অন্ধকারে ফুটে ওঠে ফুল আর গতি বাড়ে কণার জগতে
অপ্সরারা এসে বসে ঊরুর ওপর তার পরও
ঠিকঠাক থেকে যায় নক্ষত্রদঙ্গল
তালাবন্ধ অন্ধকার সিন্দুকে ঘুমিয়ে আছে সাতনরি হার
খুন আর কলঙ্কের ভয় দেখাচ্ছে চাঁদ
রুগ্‌ণ মানুষেরা সব কেমন আকাঙ্খা নিয়ে চেপে ধরছে নারীদের হাত
বেড়ালশিশুর মতো আঁচড়েছিল এক পদ্যকার
খুদেদের জলসার থেকে দূরে থেকে যাক যতোই কবিতা
অশরীরীদের নখে তার রক্ত ঝরে
একদল বৃহন্নলা কবিতাকে নিয়ে গেছে ওদের ডেরায়



মায়াবী কোলকাতা

অবিমৃশ্যকারিতায় দিন কাটে আমাদের অনায়াসে কত লক্ষকোটি
মানুষেরা গুমোট গোধূলি সন্ধ্যা ভুলে
এ ওকে ডিঙিয়ে দৌড়ে টাল খেয়ে ঘরে ফিরে যায় এইসব
দেখেটেখে বিজ্ঞাপক নিয়নভাষার মতো আমার নির্বোধ মাথা জ্বলে আর নেভে
যেদিকে এগোই আলো ময়দানের আলোকস্তম্ভের মতো ভীষণ উজ্জ্বল
যেখানে সেঁধোই বড় মর্মন্তুদ গাঢ় অন্ধকার
নেড়িকুকুর উদ্বাস্তু নুলো কুষ্ঠরোগী মানুষের ভিড়ে
উর্মিল মুখর হয়ে আছে
আমার সময় কাটে চোখের আরামে মনে দোলা দ্যায় ধাতব সঙ্গীত
মায়াবী কোলকাতা
পোষা গোক্ষুরের মতো আক্রোশে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে
আফিমসেবীর চোখে দেখি গির্জা একা পড়ে আছে
হনুমানমন্দিরের ঘণ্টা ভারী শব্দ করে বাজে শুনতে পাই
ভাতের জন্যেই পথে চতুর হয়েছে আজ কটাক্ষ ও হাতের রুমাল
বিবাহ হয়েছে তবু অনেকের পমেটম পুরুষের সাথে
হাসিখুশি হেঁটে যায় সারে সারে সুখী গৃহকোণ


অন্তহীন জেব্রাঋতু

আজও নাকি জন্ম নেয় ভালোবাসা, — ভালোবাসা তোমার কী দোষ !
জেটির সূর্যাস্তে যারা নৌকো নেয়, পিউলিপুচ্ছের আলো খোঁজে
লোভের সীমানা ভাঙে, ভস্ম ইন্দ্রিয়ের রেণু ছড়ায় আকাশে
তারাই প্রেমিক, যারা বহুশ্রুত ভোরে এই পোড়া শহরের
পুনর্জন্ম হতে পারে ব’লে কান পেতে শোনে ভৈরবীর সুর ?
কচুরিপনার ফুল, স্নিগ্ধ চাঁদ, মরচে ধরা ট্রেনের হুইসিল
আজও আছে, — ঝুমকোলতা, জানলাপরী, গোড়ালি মঞ্জীর …কেন তবে
জড়ানো আঙুল খোলে, লগ্নশঙ্খ ভেঙে যায়, চুমু খসে পড়ে ?
পপির প্রান্তরে আমরা কাটিয়েছি প্রায় অন্তহীন জেব্রাঋতু
রঙিন দিগন্ত ছিল, অভ্র ছিল, ওষ্ঠাধর দারুচিনিমাখা
চন্দন-চিতার গন্ধ ওড়াউড়ি করেছিল ভোরের বাতাসে
বন্দরের রতিবিছানায় শুয়ে কে আর কল্লোল শুনেছিল
কারো চেতনায় নদী ছিল নাকি, প্রস্রবণ ? মেহনমদির
শিশিরের শীশমহল সিরসিরিয়ে উঠেছিল রক্তের প্রদোষে
আঁধারে নিঃশ্বাস সত্য, হরমোননিক্কন, হু হু আদ্রদেশ, থুতু
পপির প্রান্তরে আমরা কাটিয়েছি প্রায় অন্তহীন জেব্রাঋতু


নিরীশ্বর পৃথিবীর বুলেটিন


স্নায়ু জননীর তুমি আদুরে খোকন, আবছা চেতনার গাদ
আর্দ্রতার তুলনায় বৃষ্টি কম, তবু ফোটে কদম কেশর
বিষাদ লুকোতে চেয়ে সোহাগমুখোশ পরে আছে গুলমোহর
ভোর বলে সেরকম কিছু নেই, ভৈরোঁ টৈরো ঘোরের প্রমাদ
সরব স্মারকলিপি চতুর্দিকে, মরা ছুঁচো ঠুকরে খাচ্ছে কাক
অস্তিত্বের টকমিষ্টি চরাচরে ঘোরো ফেরো, কে তুমি স্টকার
পরীর বাগানে রাত্রি শিস দেয় ফেরাতে পারোনা তার ডাক
বিনিদ্র তামাক ফুঁকে সময় ওড়াবে তুমি, সাধ্য কি তোমার
নিরীশ্বর পৃথিবীর বুলেটিন জমে ওঠে লেখার টেবিলে
ওঠো উঠে পড়ো, গেঁতো শিকারী, মেরুর হাঁস খেলা করে বিলে
সন্ধ্যায় বাংলোয় ফিরে মদ্য , মাংস চমৎকার রেঁধেছে মকবুল
প্রবৃত্তি , গভীর রাত্রি, এপাশ ওপাশ করছে যোষিৎপুতুল
ব্যাং ডাকলেই অভিসার, রন্ধ্রগুলো বন্ধ করে ললিতে মধুরে
গ্রহান্তর থেকে দ্যাখো উড়ে আসছে দেবদূতের মতো কিছু কবি
অধুনা নর্দমাগুলো আমোদিত হয়ে উঠছে অতীত কর্পূরে
কামারশালায় ফুটছে কাচফুল – রক্তজবা আকন্দ করবী
তিতির কাজলটানা চোখে হেসে খুন হয় কখনো কাঁদে না
সিন্ধুতীরে শুয়ে কবি জলের আদর খায় গায়ে মাখে ফেনা


কবিদের ভবিষ্যৎ


পৃথিবী অনেক বিরল প্রাণী ১০২, ১০১, ১০০, ৯৯ এভাবে
কমতে কমতে লুপ্ত হয়ে গেছে
কারো কারো মতে
সেইদিনটি দূরে নয় যেদিন কবিতা
মানুষের মাথা থেকে কর্পূরের মতো উবে যাবে
কমতে কমতে কোনোদিন জন্তুদের মতো
কবিরা বিরল হবে
কবিদের জন্য স্যাংচুয়ারি
তৈরি করে সরকারের ট্যুরিস্ট অফিস
দৈনিক কাগজে ছাপবে একপাতা সচিত্র বিজ্ঞাপন
অন্য অভিমতও আছে, মনে করো, কয়েক বছরে
যেরকম বেড়ে গিয়ে কবিদের সংখ্যা আজ তিন লক্ষ পঁচিশ
তাতে ভয় হয় হয়তো কবিপল্টনেরা এক নিশুতি রাত্তিরে
তামাম গেরস্তবাড়ি হানা দেবে গেরিলার মতো, বলবে : শালা
কেরানি অফসার উল্লু ভুঁড়িদাস কুচুটে রাজনীতিবিদ ফক্কুড়ে মাস্তান
বড় দীর্ঘদিন জ্বালিয়েছ
আজ চলো তোমাদের সঙিনে চড়াবো, বুঝবে কীরকম মজা
বহুদিন পদেপদে অপমান অবজ্ঞা তামাশা চড়চাপড়
খেয়ে অভিমানে গেছি পার্কে একা ময়দানে বেশ্যার পাশ দিয়ে
হেঁটে গেছি নিরুদ্দেশ
ঘরে ফিরে ভাতের থালায় দীর্ঘ পিঁপড়ের মিছিল দেখে
জল খেয়ে শুয়েছি বিছানায়
শুয়ে শুয়ে প্রার্থনা করেছি, মর্ফিয়ুস,
যদি অনুমোদন করেন
কিছু রোমহর্ষক স্বপ্ন–যথা, হত্যাকাণ্ড অভ্যুত্থান
আজন্ম কুকুর হয়ে থেকে যাব আপনার ডেরায়
আপনার নুন খাব আর গুণ গাইব অবসরমতো…


একটি বালিকার দুইপাশে

আমরা বোঝাপড়া করে শুয়ে পড়ি একটি বালিকার দুইপাশে
দুজনেই ভাগাভাগি করে নিই একটি করে হাত স্তন উরু
আধখানা হৃদয় আধামনোযোগ একটি করে কান চোখ ভুরু
টের পাই বালিকাটি আমাদের সমান সমান ভালোবাসে
ভারতীয় দণ্ডাবিধি মতে আমরা কেউ কিন্তু এমনটা পারিনা
কার্যত সবকিছু পারি যদি থাকে খাদ্যখাদকের বোঝাপড়া
খাদ্য মানে বালিকা যেহুতু আমরা খাদকের অহং ছাড়ি না
অথচ বালিকা জানে সে নিজে পুকুর আমরা নির্বিষ জলঢোঁড়া
স্বৈরিনী হবার শিক্ষা পেয়ে মিষ্টি বালিকাটি খিলখিলিয়ে হাসে
আপ্যায়নকারী উরুবিস্তার বিষয়ে ওর প্রশিক্ষণগুরু
আমরা ওকে ব্যবহার যত করি মনে হয় অব্যয় অপ্সরা
ওর কাছে হার মানে পুনম ধীলন টিনা পদ্মিনী জারিনা
ওদের বিবাহ হবে একদিন বড় হয়ে ওদের মেয়েরা
মায়েদেরও টেক্কা দেবে তবু এই বা

1 comment:

  1. 'একটি বালিকার দুইপাশে' কবিতাটির শেষ লাইন অসম্পূর্ণ।
    ঠিক করুন।

    ReplyDelete