আমার নস্টালজিয়ায় তারকোভস্কি
‘সিনেমা বানানো
হয় সময়ের মোজাইক দিয়ে’।
‘আমরা মনে করি
শিল্প আসলে জীবন কে জানার একটা পদ্ধতি। এটা ভুল। জীবন কে জানা যায়না। শুধু অনুভব
করা যায়। জ্ঞান আরও বেশি অজ্ঞানের দিকে ঠেলে দেয় আমাদের। আমরা শিল্প সৃষ্টি করি
জীবনের অর্থ কী এটা আর একটু ছড়িয়ে বোঝার জন্যে’।
‘অনেকেই আমাকে
প্রশ্ন করেন, আমার অমুক ছবির তমুক দৃশ্যের মানে কি? এসব শুনলে আমার বিরক্ত লাগে। আমি মনে করি দৃশ্যের আলাদা করে কোনও মানে হয়না। তাদের অর্থময়তা তাদের মধ্যেই
নিহিত থাকে। ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ তাদের অন্তর্গত শক্তিকে নষ্ট করে দেবে’।
শব্দ কিভাবে যেন শব্দকে
টেনে আনে। ধ্বনি যে ভাবে টানে ধ্বনিকে। ছবি নিয়ে আসে আরও অজস্র ছবি্র ধারাস্রোত।
আর এই সবের সংহত কোনও রূপ যদি কোনও শিল্প সৃষ্টর মধ্যে খুঁজে পাই তখন বুঝি, নিছক
সচেতন মন শুধু নয়, শুধু জ্ঞানের আকাঙ্খা নয়, অন্য কোনও তৃষ্ণা, আরও কোন প্রবল
তাড়না কাজ করছে এই সৃষ্টির অন্তরালে। আন্দ্রেই তারকোভস্কি’র সিনেমা আমাকে বারেবারে
মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি, ইশ্বর, ইতিহাস, সময়, মহাকাশ, মানুষের মন, এই সবকিছুর
সারাৎসারে এমন অনেক সুর অন্তহীন বেজে চলেছে, যা আসলে সময়েরই এক অনন্ত প্রবাহ। সেই আদি অন্তহীন প্রবাহের সামনে সমস্ত
যুক্তি ও ব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়, নিষ্ফল, হয়ে যায়।
স্পর্শ আর বাক।
কথা। প্রকাশের দুটো আলাদা রাস্তা। তবু এই দুটো রাস্তাই আমাদের তার কাছে নিয়ে যায়।
যেন এরাই একমাত্র সেতু। আমার সাথে তার যোগ সম্পূর্ণ করে। কার কাছে নিয়ে যায়? কার
সাথে মিলনের কথা বলা হচ্ছে? জানিনা? না। আমরা জানিনা। কখনো তার নাম দিই ঈশ্বর।
কখনো বলি প্রকৃতি। কখনো মহাকাল। কখনো বলি মৃত্যু। যে নামেই ডাকি সে একই রকম
রহস্যময় হয়ে থাকে। জ্ঞানের পথ দিয়ে হেঁটে কিছুতেই তার কাছে পৌঁছতে পারিনা।
তারকোভস্কি’র
ছবিতে এই তৃষ্ণার কথা বারে বারে উঠে আসে। কোথা থেকে জন্ম নেয় এই তৃষ্ণা? কেন
তাড়িয়ে বেড়ায় আমাদের? কেন যা কিছু দৈনন্দিনের, রোজকার জীবন আর পারিপার্শিকের মধ্যে
যা কিছু আমাদের ধরে থাকে, সেই সব কিছুকে অন্য কোনও মাত্রায় দেখতে চায় মানুষ? কেন
এমন একটা মুহূর্তের স্বপ্ন দেখে যা তূরীয়, যা উন্মাদ, যা নিজেকে আত্মবলি দিতেও
পিছপা হয়না? আমাদের মনে পড়বে, স্যাক্রিফাইসের শেষ দৃশ্য, আলেকজান্ডার, সারা জীবন
যিনি বিদ্যা আর জ্ঞানের জগতে মগ্ন থেকেছেন, সেই মানুষই নিজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে
দিয়ে উন্মাদের মত ছুটছেন প্রান্তর আর জলাভূমির ওপর দিয়ে। মনে পড়বে নস্টালজিয়ার সেই
মানুষটির কথাও, নিঃসঙ্গ, আত্মমগ্ন, লোকে যাকে পাগল নয়ত অপরাধী মনে করে। ছবির শেষের
দিকে সে যখন টাউন স্কোয়ারে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে, সেই দৃশ্যের কথা।
আত্মহত্যা করলেও
সে নিজে জানতো এটা কোনও রাস্তা নয়। সারা পৃথিবীতে যে হিংসা আর হানাহানির প্লাবন,
তাকে প্রতিহত করার একটাই পথ আছে। কথাটা সে বলেও গিয়েছিল এ ছবির প্রধান চরিত্রকে।
আপাতদৃষ্টিতে কী তুচ্ছ, সরল, অর্থহীন এক প্রস্তাব, যাকে বাস্তবতার যুক্তিতে খেপামো
ছাড়া আর কিছুই বলা যায়না। আর সেই অন্য মানুষটি, যে নিজে একজন নির্বাসিত, রাশিয়ান
কবি, যে ইটালিতে এসেছে সতেরোশ শতাব্দীর অপর এক নির্বাসিত রাশিয়ান সঙ্গীতকারের
জীবনী লিখবে বলে। এই মানুষটি তার নিজের সমস্ত ব্যাক্তিগত ভয়, একাকীত্ব, সংশয়,
সত্তেও সেই মৃত মানুষটির কথা রাখে। অন্ধকার রাতে, ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে সে হাঁটে জল
শুকিয়ে যাওয়া, কাদা পাঁক আর খানাখন্দে ভরা পুলের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত অবধি।
তার হাতে একটা মোমবাতি। হাওয়ায় সে মোমশিখা বারবার কেঁপে ওঠে। নিভে যায়। তবু থামলে
চলবে না তার। সে আবার ফিরে যায় পুলের সেই প্রান্তে যেখান থেকে সে শুরু করেছিল। মোম
জ্বালে। দুহাতে আড়াল করে, চেষ্টা করে সেই শিখা কে বাঁচিয়ে রাখতে। পারেনা। ফের
ব্যর্থ হয়। ফের ফিরে যায় শুরুর প্রান্তে। এই জ্বলন্ত শিখাটুকু বাঁচিয়ে রেখে পুলের
অন্য প্রান্তে পৌঁছতে হবে তাকে। এই মুহূর্তে সে আর কিছু জানেনা। জানতেও চায়না। তার
সমস্ত শক্তি দিয়ে, মন দিয়ে, সে শুধু ওই শিখাটিকে আড়াল করে রাখতে চায় প্রবল বাতাসের
থেকে। তার হাত কাঁপে, পা দূর্বল হয়ে আসে। সে হাল ছাড়েনা। আর একসময় তার সমস্ত ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে সে পুলের অন্য প্রান্তে
পৌঁছয়। জ্বলন্ত মোমবাতি নামিয়ে রাখে পাথরের বেদীতে। তার অবসন্ন শরীর এতক্ষণে
লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
ফেথ শব্দটির সঠিক
বাংলা কি হবে, আমি জানিনা। আস্থা হয়ত কাছাকাছি অর্থ বহন করে। কিন্তু তারকোভস্কি
তাঁর ছবিতে, দৃশ্যের পর দৃশ্যে, নানান চরিত্রের মাধ্যমে, একের পর এক সিচুয়েশনের
মধ্যে দিয়ে, ফেথ কে এমন একটা স্পিরিচুয়াল মাত্রায় পৌঁছে দেন যেটাকে ঠিক আস্থা বা
বিশ্বাস বলে ব্যাখ্যা করা যায়না। এক সাক্ষাতকারে তিনি নিজেই বলেছিলেন এ সম্পর্কে।
“দর্শক কিভাবে
নেবে আমার ছবিকে, কী ভাবে ব্যাখ্যা করবে, এসব নিয়ে আমি ভাবিনা। আমি ছবি বানাই এমন
ভাবে যাতে দর্শকেরা ছবি দেখে একটা স্পিরিচুয়াল স্তরে পৌঁছতে পারে”।
স্পিরিচুয়ালিটির
কথা ঘুরে ফিরে আসে তারকোভস্কি’র শিল্পভাবনায়। ব্যাপারটাকে বিদেশের সমালোচকেরা নানা
ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। যে প্রসঙ্গে বাইবেল ও খ্রীষ্টধর্মের কথাও অনেকবার এসেছে।
আমার নিজের অবশ্য তারকোভস্কির স্পিরিচুয়াল ভাবনাকে কোনও ধর্মীয় ভাবনার অনুষঙ্গ বলে
মনে হয়না। তাঁর ফিল্ম নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি নিজে বেশির ভাগ সময়ে ফিল্মকে কবিতা ও
সঙ্গীতের একটা মিলন পরিসর বলেছেন। এই দুই শিল্প মাধ্যমই প্রত্যক্ষ বাস্তবকে অন্য
অনেক মাত্রায় বা স্তরে নিয়ে যেতে পারে। সেই স্তর হয়ত আপাত দৃষ্টিতে বিমূর্ত।
কিন্তু তাতে তারকোভস্কি’র মত শিল্পীর কিছু আসে যায়না। কেননা তিনি জানেন, পৃথিবীতে
শুধু দু ধরণের চিত্রপরিচালক আছেন। একদল যাঁরা দেখা বাস্তব কে পর্দায় নকল করতে চান।
আর একদল যাঁরা নিজস্ব জগৎ নির্মাণ করতে চান। এই দ্বিতীয় গোত্রের পরিচালকেরা
প্রধানত কবি। সময় ও ইতিহাসের, চেনা বাস্তবের অনুসরণ বা অনুকরণ করতে চাননা। তাঁরা
যেটা সৃষ্টি করেন সেটা আমাদের পরিচিত এবং অপরিচিত বাস্তবের সাথে আরও অন্যতর
বাস্তবের এক সংযোজন।
আমি যখনই
সোলারিস, স্যাক্রিফাইস, নস্টালজিয়া বা আন্দ্রেই রুবলিয়ভের কাছে ফিরে যাই ততবারই অনুভব করি, এই সব ছবির অনির্বচনীয় দৃশ্য
প্রবাহ যেন তাদের সমস্ত আত্মাকে একত্রিত করে, প্রবল কোন তীব্রতায়, অনেক, অনেক বড়
এক বিশালতাকে ছুঁতে চাইছে। যে বিস্তার কে আমরা কখনো প্রকৃতি, কখনো ঈশ্বর, কখনো বা
মহাকাল বলে ডাকি। যার আদি আর অনন্ত, কোনটাই আমাদের জানা নেই।
এ লেখা শুরু
করেছিলাম স্পর্শ আর বাক এর কথা বলে। ফিরে আসি সেখানে। মিরর ছবির প্রথম দৃশ্যটির
কথা ভাবুন। সারা পর্দায় আমরা ছেলেটির মুখ দেখি। কথা বলতে গেলে তার কথা আটকে আটকে
যায়। তোতলায়। থেরাপিস্ট তাকে বলেন তার দুটো হাত সামনে প্রসারিত করতে। বলেন
আঙুলগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে। ছেলেটি নির্দেশ পালন করে। থেরাপিস্ট পাশ থেকে
বলতে থাকেন, তোমার সব টেনশন তোমার আঙুলের ওপর রাখো, দেখো তোমার আঙুল এখন শক্ত আর
কঠিন হয়ে উঠছে। এতটাই যে তুমি আর তাদের নাড়াতে পারছো না। তারা এখন পাথরের মত শক্ত।
বলতে বলতে তিনি ছেলেটির রগের পাশে হাত রাখেন। ধীরে ধীরে বলেন, এবার তোমার মাথার
মধ্যে যে টেনশন সেটা আমি সরিয়ে দিচ্ছি। দেখো তোমার আঙুল আবার নমনীয় হয়ে উঠছে। তুমি
আবার হাত নাড়তে পারছো। এখন থেকে তুমি আবার স্পষ্ট কথা বলতে পারবে। কোথাও আটকাবে না
আর। বলো, আমার সাথে বলো, আমি কথা বলতে পারি।
এই দৃশ্যের
ব্যাখ্যা আমি করবো না। একটি কবিতার জন্মের মত এই দৃশ্য। যে কোনও ব্যাখ্যা তাকে নষ্ট করে দেবে। শুধু একটা
অদৃশ্য সম্পর্কের কথা বলবো, যা হাত ও বাক এর এই সংযোগের মধ্যে দিয়ে তারকোভস্কি
দেখান আমাদের। আদিতে যা আছে তা স্পর্শ। আমার হাত সেই স্পর্শ অনুভব করেছে।
অন্ধকারে, গর্ভে, মহাকাশে, সে শুধু স্পর্শ দিয়ে অনুভব করেছে সবকিছু। সে সময়কে
ছুঁতে চাইছে। যে সমকে সে চেনেনা। তার বর্তমান, তার অতীত, তার ভবিষ্যৎ, সমস্ত কাল
কে সে জানতে চেয়েছে এই সময়, এই মুহূর্ত, এই অস্তিত্বের অংশ দিয়ে। হাত আমার শরীরের
সেই প্রথম অঙ্গ যা আমি ব্যবহার করেছি এই পৃথিবীকে অনুভব করবার জন্য। আর সময়ের সাথে
সাথে সেই হাতই, নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে পেরেছে আমার শরীরের বাইরের আর সব কিছুকে।
আর এই স্পর্শই আমাকে শিখিয়েছে, অনুভব করেছো, এখন প্রকাশ করো। কথা জন্ম নিচ্ছে এখন।
সে এই অনুভব কে প্রকাশ করতে চায়। কার কাছে?
তারকোভস্কি আমাকে
শেখান এই প্রকাশ শুধু তার কাছে যার থেকে আমার সকল অনুভব উৎসারিত হল। তাকে অনুকরণ
নয়। তাকে অনুসরণ নয়। শুধু তার সৃষ্টির সাথে নিজেকে, নিজের অনুভব কে, সেই অনুভবের
প্রকাশ কে মিলিয়ে দেওয়ার জন্যে এই যা কিছু সৃষ্টির আয়োজন আমাদের।
তারকোভস্কি যখন
বলেন শিল্প হল স্পিরিচুয়ালিটিতে পৌঁছনোর একটা মাধ্যম, তখন এই অর্থেই বলেন বলে আমার
মনে হয়।
No comments:
Post a Comment