Tuesday 10 April 2018

চন্দন ঘোষ

ধারাবাহিক গদ্য

    


        চিকিৎ-'শকিং' ডায়রিঃ পুলিশে ছুঁলে


কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, পুলিশে ছুঁলে বাহাত্তর। তা ডাক্তারি করতে গিয়ে সৌম্যকে বেশ কয়েকবার পুলিশে ছুঁয়েছে। কেবলমাত্র একবার ছাড়া কোনও ঘা-ই সে খায়নি কখনো। নাইট ডিউটিতে ভাটপাড়া হাসপাতালে কতবার তার সঙ্গে গল্প করতে দু-এক জন পুলিশ অফিসার আসতেন। "রাতভর ক্রিমিনাল তাড়া করতে গিয়ে রেল লাইনে আছাড় খাওয়া কাঁহাতক আর ভালো লাগে, ডাক্তারবাবু। তাই আপনার সঙ্গে একটু আড্ডা মারতে চলে এলাম।" 

একবার এক অফিসার একজন কয়েদীর মেডিক্যাল করতে নিয়ে এলেন। সদ্য হওয়া কল্যানী এক্সপ্রেসওয়েতে তাড়া করে ধরেছেন লোকটাকে। সামাদ আলিকে দেখলে এসব কিছু বোঝা যায় না। নিরীহ চাষীবাসী চেহারার ছাপোষা গাট্টাগোট্টা একজন মাঝবয়সী মানুষ। অফিসার বলেন, ডাক্তারবাবু এ যে কত ডাকাতি, খুন আর রেপ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। শুনে চমকে ওঠে সৌম্য। কয়েদীর পেটে রুলের গুঁতো দিয়ে অফিসার বলেন, বল শালা এবারের ডাকাতি আর রেপের চেষ্টা কেন করেছিলি? লোকটি কঁকিয়ে উঠে বলে, মারতেছেন ক্যানো, বাবু। ছোটো ম্যায়েডার  নিকে করাতি হবে। ট্যাঁহার দরকার ছেল, বাবু। তাই বেরোইছিলাম যন্তর নিয়ে। তা মাগীডা আটকালে ক্যানো? তাই একটুস জোরাজুরি কত্তি হল। এক্টুস জোরাজুরি! বলে কী! সৌম্য তো থ।

তবে পুলিশের ছোবল খেতে খেতেও একবার বেঁচে গেছিল সৌম্য। বারাসাতের এক এস পি একবার এক নার্সিংহোম মালিককে ক্যাচ দিয়ে সৌম্যকে ওনার কোয়ার্টারে গিয়ে ওনাকে দেখতে বলে। তখন সদ্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছে সৌম্য। নিমরাজি হয়ে সৌম্য অবশেষে গেল। তো সেই পুলিশকর্তা তাকে ঝাড়া এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখে। কী অজুহাতে? না সাহেব এখন কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন। বিরক্ত সৌম্য লিখে দিল আপনাকে ভর্তি হতে হবে। পুলিশবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। সে কী আমি তো কোনোদিন ভর্তি হই নি। সৌম্য বলে, হননি, এবার হবেন। পুলিশবাবু ক্ষুব্ধ। সৌম্য চলে এল। পরদিন অ্যাপোলো থেকে ওর বন্ধুর ফোন। গুরু, তোর প্রেসক্রিপশন নিয়ে এক পুলিশ এসেছিল। আমি বলেছি, ভর্তি না হলে কোনো কথা নেই। পরদিন আবার নার্সিংহোম কর্তার ফোন। দাদা, আর একবার ওনাকে একটু দেখতে হবে। সৌম্য সাফ বলে দিল, আমার চেম্বারে এসে দেখালে তবে দেখব, নইলে কিছুতেই নয়। পরে শোনে, কর্তাটি খুব খচে গেছেন। বলেছেন, এত বড়ো সাহস ডাক্তারের। আমি ওকে দেখে নেব। নার্সিংহোম কর্তা তো মহা ফাঁপরে! বলে, স্যার, আপনার যেমন ক্ষমতা আছে, ওনাকেও কিছু লোক এ তল্লাটে চেনে। কাইন্ডলি এ সব নিয়ে ঝামেলা করবেন না। অনেক গজগজ করে কত্তা অবশেষে শান্ত হলেন। সৌম্যকেও আর হ্যাপা পোয়াতে হল না।


তবে পুলিশের লাঠির কত জোর তা একবার চাক্ষুস করেছিল সৌম্য। সেবার চাকদা হসপিটালে সবে সন্ধের ডিউটি ধরেছে। হঠাৎ হইহই করে একদল ছেলে এসে এক কালো দশাসই মহিলাকে অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় এনে ফেলল। মহিলাটিকে বীভৎসভাবে মারা হয়েছে। জায়গায় জায়গায় ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। ছেলেগুলো মহিলাকে ফেলে দ্রুত পালাল। যাবার আগে বলে গেল, ডাইনি বলে ওকে একদল মানুষ পিটিয়েছে। ওরা এখানেও হামলা করবে। ডাক্তারবাবু সাবধান, একে এক্ষুনি এমার্জেন্সি ঘরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিন। নইলে আপনিও বাঁচবেন না। সৌম্য জিডিএ ছেলেটাকে দ্রুত থানায় খবর দিতে পাঠিয়ে মহিলাকে এমার্জেন্সি ঘরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিল। দেখতে দেখতে পালে পালে লোক হস্পিটাল চত্বর ভরে ফেল্ল। তারা উন্মাদ, চেঁচাচ্ছে ডাইনিকে ছেড়ে দে আমাদের হাতে। নিকেশ করব ওকে। ওরা হাসপাতালের বাতিল অ্যাম্বুলেন্সের ওপর চড়ে উন্মত্ত নৃত্য করছে। এর মধ্যে সৌম্য পেছন ফিরে একমনে সেলাই ও ড্রেসিং করছিল। সঙ্গে একমাত্র সিস্টার ও জিডিএ কালুরাম।  মোটা গরাদ দেওয়া জানলাটা বন্ধ করা হয়নি, খেয়াল ছিল না। সেখানে দাপাচ্ছে কিছু শয়তান। অশ্রাব্য গালাগাল করছে। ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ বলে ওঠে, এই বাঞ্চোৎ ডাক্তার, আবার সেলাই করা হচ্ছে। ছেড়ে দে শালা আমাদের হাতে। ওকে আমরা বুঝে নেব। গরাদের এপাশে নিরাপদ সৌম্য এবার সাহস সঞ্চয় করে বলে ওঠে, কে বললি রে কথাটা। বলতেই ভীড় ঠেলে কালো মুশকো একটা ছেলে বেরিয়ে আসে। বীভৎস তার চাউনি। বলে, আমি বলেছি, কী করবি শালা। সৌম্যর মাথায় খেলে যায় থানায় খবর পাঠানো হয়েছে। ও ঠান্ডা গলায় বলে, এক্ষুণি বুঝতে পারবি কী করতে পারি। বলে ঠিকই কিন্তু কী ভরসায় বলে, বুঝতে পারে না। হঠাৎ গাড়ীর  আওয়াজ। পুলিশের গাড়ি। জনতা একটু যেন বেসামাল। কয়েকজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে বেধড়ক লাঠি চার্জ করছে। বারান্দাটা একটু ফাঁকা। সৌম্য সাহস করে ঘর থেকে বেরোয়। দেখে একজন পুলিশ উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরছে। বলে ডাক্তারবাবু একটা লাঠি হবে। আমি ডান্ডা আনতে ভুলে গেছি। সৌম্য বলে, লাঠি কোথায় পাব? এই দরজার বাঁক আছে। চলবে। লোকটা বাঁক হাতে রে রে করে জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র দশজন পুলিশ সেদিন যে বিক্রমে তিনশ থেকে চারশ লোককে পেঁদিয়ে হাসপাতাল ছাড়া করেছিল তা স্মরণ করে আজও কৃতজ্ঞতায় মাথা নিচু হয়ে আসে সৌম্যর।
পুলিশই ওকে বাঁচিয়েছিল সেদিন এবং ওই ডাইনি নামক মহিলাকে ওদের গাড়ি করে কল্যাণী হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। 

সেদিনের পুলিশী বীরত্বের কাহিনী সৌম্য কোনোদিন ভুলবে না। তাই সে এখন মজা করে বলে, বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, পুলিশে ছুঁলে যমও আসে না।

No comments:

Post a Comment