Tuesday 10 April 2018

হিন্দোল ভট্টাচার্য




মোংপো লামার ডায়েরি- তৃতীয় পর্ব

না, আমি বলতে পারব না এসব লেখার সত্যি কোনও পাঠক আছে কিনা! আর না থাকলেই বা কী! আমার কী মনে হয় জানো, সত্যিকারের অনুভূতির তেমন কোনও সাক্ষী থাকে না। তুমি শুধু সহজভাবে তাকে মনে করতে পারো। এছাড়া আর কিছুই না। তুমি বলছ, এমন একটা দেশে আছ, যেখানে বসে তুমি কল্পনাই করতে পারছ না এক সহিষ্ণু সময়ের কথা। মানছি এক প্রবল ধর্মীয় হানাহানি চলছে। আচ্ছা, ধর্ম মানে ঠিক কী! আদৌ এর কোনও প্রয়োজন আছে কি? দ্যাখো, এসব সকলের জানা কথা। তোমারও। আমিই বা তোমাকে নতুন করে কি বলব? আর তাছাড়া এই লেখা বা এই সব কথা কি সেই সব মানুষের কাছে পৌঁছবে যারা সত্যি ধর্ম বা অধর্ম নিয়ে ভাবিত? যারা সত্যি ধর্মকে একটা পরিচয় হিসেবে মনে করে, রামকে ভগবান, আর ধর্মের সাম্রাজ্যবিস্তারকে এক পবিত্র কর্তব্য? এ লেখা তো তাদের কাছে যাবে না। এ লেখা হল অন্ধকারে বসে নিজের মনে বিড়বিড় করা এক পাগলের কথা। শুনতে পাচ্ছ বাইরে গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ? কত দ্রুত তারা দৌড়ে যাচ্ছে? আর তুমি এখানে বসে ভাবছ তোমার কথায় তোমার ভাবনায় পৃথিবীর কারু কিছু এসে যাবে! ভাবছ এক প্রবহমান চেতনাহীনতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে তুমি কী কথা বলবে কার সাথে? এ ভাবা অন্যায় নয়। এই দেখো, কেমন মন্দিরের মধ্যে দিনের পর দিন ধরে একটা আট বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে হত্যা করল কিছু লোক। তাদের আবার আড়াল করতে চাইছে কিছু হিন্দু ফ্যাসিস্ট কিছু নেতা। তারাই হল দেশের শাসক। তুমি কি ক্লান্ত অনুভব করছ? একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। কখনও হিন্দু ফ্যাসিস্টরা দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিচ্ছে, কখনও শিশুকন্যাকে মন্দিরের মধ্যে দলধর্ষণ করছে, কখনও স্রেফ পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে চলছে গ্রামে গ্রামে হানাহানি, রক্তপাত, সরকারের সন্ত্রাস। এবারে কি তুমি প্রতিক্রিয়া লিখতেও ক্লান্ত বোধ করছ? স্বাভাবিক। আর কিছুই লিখো না। কারণ গোটা সমাজটাই একটা বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তুমি কিছু কথা বলতে পারো। কিন্তু সেই কথাগুলো সেই আক্রান্তকারীদের বিড়বিড়ানি হয়েই থাকবে। আর তুমি কাউকে বলতেই পারবে না ধর্ম মানে ক্ষমতার রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তুমি বোঝাতে পারবে না, ধর্ম মানে যদি দর্শন হয়, যদি কাব্য হয়, তবে তার থেকে অন্তত কয়েক আলোকবর্ষ দূরে দাঁড়িয়ে আছে আজকের পৃথিবী। আর তুমি কি ভাবছ এ কথা কেউ জানে না? তুমি আদৌ কোনও নতুন কথা বলছ না। নতুন ভাবেও বলছ না। আর যা যা বলছ, সব সকলেই জানে। তাহলে কী করবে তুমি? চুপ করে যাবে? যেতে দেবে সময়কে?

আসলে ঘৃণা হচ্ছে তো? কার প্রতি? নিজের প্রতি নয় কি? একটা না একটা সময় তো আসেই, যখন সমস্ত মানবজাতির ব্যর্থতাকে নিজের জীবনের ব্যর্থতা বলে মনে হতে থাকে। আচ্ছা তুমিই বলো, ঈশ্বরের নিজের কোনও ধর্ম আছে কি? ঈশ্বর নিজের কোনও ধর্ম , বিশেষ করে মানবজাতির জন্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন কি? বা আদৌ করতে চান কি? এই যে সমগ্র মহাজগত নিজের মতো করে তৈরি হচ্ছে, ধ্বংস করছে নিজেকে, আবার তৈরি হচ্ছে, তুমি-আমি সকলেই তার অংশ। এ ছাড়া আর অন্য কোনও ধর্ম আছে কি আমাদের? যদি আমরা কিছু ধর্ম সৃষ্টি করে থাকি, তা কি আমাদের সীমাবদ্ধ দেখাটিকেই আমরা বলছি বা লিখছি, সে কারণেই না? কিন্তু এই ধর্ম তো, বলতে গেলে, আমাদের নিজেদের তৈরি করা। এই ধর্ম-এর সঙ্গে ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে কি? বিশেষ করে সেই মানবজাতির, যারা নিজেদের কামকেই এখনও পর্যন্ত বশে আনতে শেখেনি। যারা নিজেদের সন্তানতুল্য এক শিশুকন্যাকে মন্দিরে ( যার নাম নিয়ে মানুষ যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে, দাঙ্গা করেছে, তার কারণ- মন্দির এক পবিত্রতম জায়গা) দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে দিনের পর দিন, সেই মানবজাতির কাছে ধর্মের আর কী ব্যাখ্যা চাইতে পারো তুমি? ধর্ষণ শুধুমাত্র যৌনবিকৃতিই নয়, এ এক ক্ষমতাবিকৃতিও বটে। নিজের মধ্যে থাকা ক্ষমতার বিকৃতকাম মেটানো। এখানে কোনও ধর্ম নেই। আবার এও বলা যায় ধর্ম যখন প্রতিষ্ঠান, তখন তার মধ্যে ঈশ্বর নেই, ক্ষমতা আছে ।  আমরা সেই ক্ষমতার জয়গান গাইতে রাস্তায় রাস্তায় অস্ত্র নিয়ে লাফাচ্ছি। একটা মন্দির মসজিদ নিয়ে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করছি। তা নিয়ে দিনের পর দিন ধরে তর্ক করছি। হয়ে পড়ছি হিন্দু তালিবান বা মুসলিম তালিবান। কেন? আহ বললাম না , নতুন কিছু কথা আজ আমি বলতে পারব না। কারণ এই কথাগুলি আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই জানা কথাগুলিকেই আমরা আবার নতুন করে ভুলে যাচ্ছি। আমার প্রশ্ন এখানেই। কেন? আমরা বারবার নতুন নতুন করে ভুলে যাচ্ছি এই কথা কেন যে মানুষের সৃষ্ট ধর্মগুলি মানুষের তৈরি এবং অধিকাংশ ধর্মের সাথেই রয়েছে ক্ষমতার যোগ। অথবা সেই সব ধর্মগুলি জন্ম দিয়েছে অপূর্ব কিছু সাহিত্যের । জন্ম নিয়েছেও কখনও অপূর্ব কিছু সাহিত্য থেকে। আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছি এত সব কথা আবার করে নিজেকেই বলতে। কারণ আমি তুমি সে—সকলেই এ সব কথা জানি। কিন্তু মনে রাখতে চাই না। আমাদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে  এক  আত্মহত্যাপ্রবণতা। আমরা বুঝতেই পারছি না, অন্যকে হত্যা, ধর্ষণের মাধ্যমে আমরা আসলে নিজেদেরকেই ধর্ষণ করছি, নিজেদেরকেই হত্যা করছি। ক্রমশ এবং ক্রমশ।
(ক্রমশ)


1 comment: