Tuesday 10 April 2018

কণিষ্ক ভট্টাচার্য

ধারাবাহিক গদ্য
                   

                    জানলা

এই বাতাসের কাছে সে ফিরে ফিরে আসত। এই নোনা বাতাসের কাছে।
লক্ষ্মীর পাঁচালীর সেই অবন্তীনগর থেকে বাণিজ্যতরী আসত নদীপথে। মঙ্গলোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে জলযান মৃত্তিকা-বিযুক্ত হলেও কর্দমাক্ত পরিচিত ঘাটে নিকটজনেরা অপেক্ষা করত নদী পাশ ফিরে তার দৃষ্টিসীমায় বাইরে বা দিকচক্রবালে তরীর মাস্তুল মিলিয়ে যাওয়া অবধি নৌযাত্রীর অকল্যাণের আশঙ্কায় মাথার কাপড় মুখের সামনে ধরা থাকত যাতে তা শোকশব্দরোধী হয়, যাতে তা অনিবার্য অশ্রুশোষক হয়ে উঠে, যাতে তা একার ঘরে ফিরে, একার বিছানায় আছড়ে পড়া অবধি বিস্রস্ত না হয়ে যায়, পূর্বরাত্রের রতিচিহ্ন যেন দৃশ্যমান না হয়।
জলযাত্রীর দৃষ্টি কঠোর এই সমতলের দেশে ভুপ্রকৃতি বৈচিত্র্যহীন তবু জনবসতি পেরিয়ে দৃশ্য বদল হতে হতে ষোলোপাল, আঠেরোপালের জলযান বন্যজন্তু সঙ্কুল জলস্পর্শী অরণ্যের কাছে আসত। সশস্ত্র বাহিনি অপেক্ষা করত বাণিজ্যতরীর দুই ধারে। সশস্ত্র তারা, তবু আশঙ্কিত, দস্যুর কুশলতা তারা জানে, পশুর জানে না তেমন। কবে কত-পুরুষ আগে পশুদের কবল থেকে জঙ্গল উদ্ধার করে, অরণ্যছেদন করে, মাটিকে বসতি ও কৃষিযোগ্য করা হয়েছিল তা তাদের যৌথস্মৃতিতে অবসৃতপ্রায়। কিন্তু বাদাবনের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করা চোখ উপেক্ষা করত সেই মানুষদের প্রযুক্তিকে। তার প্রতি জৈবিক আগ্রহ জাগানোর মতো খাদ্যাভাব তখনও সে জানে না।
পরের ভোরে যখন লাট পেরিয়ে গিয়ে মোহনার বিস্তৃতির সামনে আসত বাণিজ্যতরী তখন হয়ত হতবাক হয়ে যেত কোনও যুবক নৌযাত্রী। সে হয়তো বণিক নয়, তাই এই বিস্তৃতির ওপারে উদীয়মান সূর্যের মধ্যে সে স্বর্ণমুদ্রাকে দেখতে পায় না। সমুদ্রফেনার শুভ্রতায় তাই তার রৌপ্যমুদ্রা রাখা নেই। সে হয়তো বা নাবিকও নয়, দিকশূন্য জলরাশি হয়ত তাকে জয় করতে প্রলুব্ধ করে না চৌষট্টিকলাপটীয়সী হয়ে। সে হয়ত কেবলই কর্মী, হিসাবরক্ষক। সে হয়ত কেবলই সহায়ক, পণ্যবাহী। সে হয়ত ভাঁড়। সে হয়ত পাচক। ফিরে যেতে চাইত সেই যুবকের মন। সেই ঘরে যেখানে সন্তর্পণে বুকের বাস সরিয়ে অসচেতন নখরাঘাতে আঙুল বুলিয়ে তৃপ্তি খোঁজে কেউ।
সপ্তডিঙামধুকর বা ময়ূরপঙ্খীর উচ্চতম কক্ষে যেখানে বণিকশ্রেষ্ঠ রাত্রিবাস করেন সেখানে কপাট পেরিয়ে আসা এমনই লবণাক্ত সমুদ্রবায়ু উত্তেজিত করে তাকে আরও সম্পদ, আরও সঞ্চয়, আরও প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে। মোমকাপড়ে মুড়ে রাখা কার্পাস কিংবা রেশম বস্ত্রের পর্যবেক্ষণ করে বণিকশ্রেষ্ঠ লবণাক্তবায়ু বড়ো ক্ষতি করে যে বাণিজ্যের।
এই নোনা বাতাসের কাছে সে ফিরে আসে বারবার।
ফিরে আসে নাকি পালিয়ে আসে তা তার মন স্বীকার করতে চায় না। প্রকাশনার কুঠুরি ঘরে অপরের অক্ষর ছানতে ছানতে ক্লান্ত লাগে বড়ো। যতিচিহ্ন হারিয়ে যায়, ক্রিয়াপদ স্থান পরিবর্তন করে, প্রযোজ্য বিশেষণ ছুটি নেয় সেদিন। তার টেবিলের পাশের জানলায় বাতাস দূরের কথা আলোও আসে না ভালো করে। জানলার ওপাশে এক চৌখুপি দালান। তার ওপরে যে চৌকো আকাশ তাকে আর দেখা যায় না টেবিলের প্রান্ত থেকে সমুদ্রবায়ু শহরে বৃষ্টি আনলে সেই দালানে নিজস্ব জলযান ছাড়ে এক বালিকা। দোহাই আলি, দোহাই আলি বলতে বলতে আক্রমণকারী হন্তারক বড়ো বড়ো বৃষ্টিফোঁটাকে এড়িয়ে জলযান চলে অভিযাত্রায় বালিকার নিজস্ব জলাধারে।
সে অপরের অক্ষর ছানে আর কেউ একজন রোজ তার জন্য শব্দ তৈরি করে কিন্তু ডাকবাক্সে ফেলে না, সপ্তাহের শেষে আসে তারই সঙ্গে। সেই শব্দ-কারিগরের কাছে পোঁছতে তাকে দুশো নব্বই কিলোমিটার উজানে যেতে হবে। শহরের পাশ দিয়ে যে নদী বয়ে গেছে উত্তরে সেই নদীর পারেই এক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কর্মীদের জন্যে নির্মিত নগরায়ন। সেই আবাসনের তিনতলার জানলা নিশ্চয়ই এখনও খোলা। সেই জানলায় সমুদ্রবায়ু পৌঁছয় না রাতের ট্রেনের শব্দ পৌঁছয়। ঝমঝম করে ব্রিজ পার হয় ট্রেন। শব্দ কারিগরের নিজের শহরের দিকে যায়। আরও একটা দিন তার কেটে যায় শহরের বাইরে। দিন জুড়ে সপ্তাহ হয়, সপ্তাহ জুড়ে মাস। ছোট্ট টেপ রেকর্ডারে কিছুই তো না হওয়ার ঝিঁঝিট গড়িয়ে চলে মোহরকণ্ঠে। একাকিত্ব এপিঠ ওপিঠ করে ঘর জুড়ে। শব্দ বোনে একজন সপ্তাহান্তে শহরে ফিরবে বলে।
বাতাস এখানে মটমট আওয়াজ তোলে জানলার পাশে বড়ো বড়ো গাছের ডালে।
সে তো একা নয়। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে বাসে উঠেছিল ওরা, বন্ধুরাও ছিল। যাবে লাট পেরিয়ে আরও দক্ষিণে মোহনার কাছে এক দ্বীপে। যেখানে নাকি বেলাভূমিকে আঁকড়ে ধরতে নেমে আসে বেগুনি ফুলের লতা। লাল কাঁকড়ার এক চলন্ত গালিচা নড়েচড়ে বেড়ায় বেলাভূমি জুড়ে। সে গালিচা যদিও উড়তে পারে না আরব্য রজনীর মতো তবে মানুষের আগমনে মিলিয়ে যায় বালির নিচে নোনা হাওয়ার ডাকে সেখানে নাকি মাথা দোলায় ঝাউগাছের পাতা। সারাবছর নাকি মানুষের পা পড়ে না সেই বেলাভূমিতে। কেবল বছরে একবার পুণ্যার্থে আসে মানুষ সারা দেশ থেকে
তাদের তো পুণ্যের দায় নেই। নাগরিক চাতুরালিতেও তারা অসংগত। হাতের মুঠোয় গোপনে আসা ইস্তেহারের ভাঁজ খুলে তারা সাদা পাতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি। তারা তাড়া খাওয়া। শহরজুড়ে প্রতিটা ফ্রেমে তাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবিই ভয় দেখায় তাদের। গোটা শহরটা যেন আয়না হয়ে ওঠে তাদের সামনে। নিজেদের থেকে তারা পলাতক। ক্যামেরা হাঁটে পাশে পাশে। ফ্রেমে অজস্র জার্ক আসে। কখনও লং-শটে দেখা যায় তারা পালাচ্ছে শহর থেকে, পালাচ্ছে নিজেদের থেকে। ফ্রেম জুড়ে বেলাভূমি। প্রথমে তাদের ত্রস্ত পা ফেলা, পা তোলা। গতি বাড়ে তারপর। নিজের কাছ থেকে দূরে যাবার জন্য এতোটা পথ তারা পায়নি কখনও। তারা এবার দৌড়য়। বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে ভাঁটার শোষণ কাদামেশা শক্ত বালি। অনেক দূরে জল। তারা দৌড়োয় পাশাপাশি কিন্তু আলাদা আলাদা প্রতিচ্ছবির থেকে। সেই প্রতিচ্ছবিগুলো তাদের নিজেদের। কিন্তু তারা তো জানে নিজেদের প্রতিবিম্বের থেকে মুখ ফিরিয়ে যে দৌড় সমুদ্রের দিকে সেখানে বেলাভূমি শেষ হলেই পথ শেষ হয়। জলের সামনে এলেই মুখ ফেরাতে হয় ক্যামেরার দিকে। নিজেদের দিকে।
সারাদিন তারা ঘরে থাকেই না। সূর্যের আগে তারা চলে আসে জলের কাছে। আলোকে জাগতে দেখে, যেন প্রথমবার। যেন তাদের ভেতরেও চুঁইয়ে যাচ্ছে আলো। যেভাবে কালো কফিতে মেশে দুধ। যেন একটা শুরুকে দেখতে পায় তারা। তাদের দৈনন্দিনতায় তো কোনও শুরু-শেষ নেই। তাপ শুষে খাঁড়ির দিকে যায় হেঁটে হেঁটে। নৌকা সারায় এক বৃদ্ধ। জোগালি তার নাতি। তাদের জলযান আবার জলসইতে যাবে। তারা বসে থাকে বালিতে। জল এগিয়ে আসে একটু একটু করে তাদের সঙ্গে আলাপ করতে। ছোঁয় তাদের অল্প অল্প করে। তারা নিজেদের ছেড়ে দেয় জলের কাছে। তারা শুয়ে পড়ে বালিতে। আকাশে-সূর্যে-জলে বিস্তৃতি শব্দটাকে চাক্ষুষ দেখতে পায় তারা। জল বাড়তে বাড়তে একটু একটু করে মাটি ছাড়া করে তাদের। পিঠের নিচ থেকে টান দিয়ে নিয়ে যায় বালি। তাদের সেই অস্তিত্ব আবার দুলে উঠে যে ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের থেকে পালাতে তারা এই দ্বীপভূমিতে এসেছিল। শরীর ছেড়ে দেয় তারা। আত্ম সমর্পণের এমন বিস্তৃত আধার, এমন অকুণ্ঠ আলিঙ্গন তারা আগে দেখেনি।   
সেখানে বিদ্যুৎ থাকে না। দিনের আলো নিভে এলে সরকারি-আবাসের কর্মী ঘরের দরজার সামনে দিয়ে যায় কবেকার সেই হারিয়ে যাওয়া হ্যারিকেন। জ্বলন্ত হ্যারিকেনের আলো কমানো। জনমানুষহীন সেই বেলাভূমিতে তিনটে হ্যারিকেনের আলো দেখা যায় রাতে। কখনও সঞ্চরমান। কখনও স্থির। আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে। বাতি নিভিয়ে দেয় তারা। শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছে। ঢেউয়ের মাথায় ফেনায় চকচক করছে জ্যোৎস্না। চাঁদ ডাকছে সেই জলকে।
সেই রাতেই আবাসের দোতলার বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিতে যায় তাদের একজন। বারান্দা থেকে দূরে দেখা যায় জল।   কেউ তাকে ছেড়ে গেছে সেই যন্ত্রণা সে শহরে যেভাবে ধারণ করতে পেরেছিল এখানে বন্ধুদের সামনে তাকে আর বইতে পারে না সে। বন্ধুরা আঁকড়ে ধরে তাকে। এবার সে কেঁদে ফেলে। হাউ হাউ করে। এক কুড়ির কোঠার যুবক এমন করে কাঁদতে পারে সে দেখেনি আগে। পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছে আকাশ। আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। এক বান্ধবীর কাঁধে মাথা রেখে কাদছিল এক বন্ধু। সে কেবল লাফ দেওয়া থেকে প্রতিহত করেছিল তাকে। তারপর আর কিছুই বলেনি। চুপচাপ বসে থেকেছে। সে এমন নিজেকে খুলে, ভেঙে কিছু প্রকাশ করতে পারে না। স্তব্ধ রাতে হাওয়া বয় শোঁ শোঁ করে এখানেও ফিরে আসে সেই মেয়েটির কোয়ার্টারের সামনের গাছের মটমট আওয়াজ। দূরে জলের ঢেউ ভাঙার শব্দ। সে সুর ধরে হল কানায় কানায় কানাকানি এইপারে ওই পারে। ও চাঁদ।
পরের দুপুরে সে আর শব্দ কারিগর মেয়ে হারিয়ে গেল। ভাঁটার সময় খাঁড়ি পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে। খাঁড়ি তখন জলশূন্য। খাঁড়ির ওপারে ঝাউয়ের জঙ্গল। বালি উঠে গেছে ঢিপি হয়ে। সেই জঙ্গলের ভিতরে নাকি বনবিবির মন্দির আছে। জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সেই মন্দির তারা খুঁজে পেল না। ক্লান্ত হয়ে তারা বসে বালি ওপর। সূর্য আসতে আসতে প্রান্তে হেলে। তাদের জমে থাকা কথা ঢেউয়ের মতো আসতে থাকে দুজনের কাছে। এক বিপুল জনবহুল শহর তাদের যে কথাকে স্থান করে দিতে পারেনি, এই বিপুল বিস্তৃতির মধ্যে সেই কথারা নেমে এল বালিতে। তাদের প্রতিচ্ছবিগুলোকে তারা ছাড়িয়ে নিতে চাইল নিজেদের থেকে। ভাঙা নৌকার কাঠের মতো ভেসে গেল সেই প্রতিচ্ছবি। সমুদ্রের ঢেউ একান্তে এগিয়ে এলো বালির দিকে। তারা বণিক নয়, তাদের জন্য সমুদ্রের ওপারে স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রা নেই। তারা নাবিক নয় তাদের জলকে জয় করার আহ্বান নেই। তারা নিজেদের বদ্ধতার থেকে সমুদ্র অবধি এগিয়ে গেছে, তার ওপারে তাদের জন্য আর কিছু রাখা আছে কিনা ভাবেনি।
দুপুর থেকে নিখোঁজ দুজন। বন্ধুরা বেরিয়ে পড়েছে সেই সরকারি আবাস থেকে। এসেছে জলের কাছে। কোথাও নেই ওরা। খাঁড়ির খাত ভরে গেছে জোয়ারের জলে। একটা ভ্যান নিয়ে তারা খোঁজে সেই বেলাভূমি সংলগ্ন ছোট্ট জনবসতি। কোথাও নেই ওরা। কোথাও। সূর্য ডোবে। চাঁদ ওঠে। পূর্ণিমার পরের রাতের প্রায় পূর্ণ চাঁদ। বেলাভূমি ভেসে যায় আলোতে।
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বালির ঢিপির থেকে নামতে গিয়ে দেখে জল চলে এসেছে সামনে। খাঁড়ির খাত আর দেখা যাচ্ছে না। থই থই জল। প্রতি ঢেউয়ে আরও একটু বাড়ছে সেই জল। নিচে নামতেই পায়ের পাতা ডুবে যায়। তখন তারা খেয়াল করে। গাছের কাণ্ডের জলের দাগ। তার মানে জল উঠে আসবে এতদূর। জোয়ার সবে আসছে। সে কাল ভোররাতে নামবে জল। জঙ্গলের পার ধরে খাঁড়ির দিকে যেতে যেতেই বুঝতে পারে এখন যা জল তাতে খাঁড়ি পার হওয়া সম্ভব নয় দুজনের পক্ষে। মেয়েটি সাঁতার জানে না, ছেলেটি জানলেও তা এখানে এখন কোনও কাজে আসবে না। তবু হাত ধরে কোমর জল অবধি নামে তারা। সম্ভব নয়। উঠে সে বসে থাকে ঢিপির সবচেয়ে ওপরে। জঙ্গলের গাছে হেলান দিয়ে। ভাবে রাতে কতটা জল ওঠে, জঙ্গলের ভিতরে কতটা গেলে রাত কাটাতে পারবে তারা। সেটাও আবার নিরাপদ হবে কিনা কোনও ধারণা নেই তাদের। দুজন নিজেদের থেকে তারা খাওয়া মানুষ বসে থাকে পরস্পরকে জড়িয়ে।
অনেকক্ষণ বাদে দূর থেকে একটা আলো আসে হাতের দোলায় দুলতে দুলতে। টর্চ। বালির ওপর দিয়ে দৌড়োয় ওরা। অয়াল ওদের দিকে না এসে বেঁকে যায় জঙ্গলের মধ্যে। অনভ্যস্ত পা হোঁচট খাচ্ছে বেগুনি লতায়। ঝাপটা খাচ্ছে ঝাউয়ের ডালে। আবার ওরা দৌড়চ্ছে, এবার জলের বিপরীত দিকে। মানুষ থেকে পালাচ্ছিল তারা। গ্লোসাইনের তীব্র আলোর থেকে পালাচ্ছিল। এবার একজন মানুষ, হাতে একটা টর্চ তারদিকে প্রাণপণে দৌড়চ্ছে দুজন।
নিপাট গ্রামের মানুষ। কাজ থেকে ফিরছেন। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। সপ্রতিভ ভাব ভেসে গেছে জোয়ারে। সে জিজ্ঞেস করে, ‘খাঁড়ির ওপারে কী করে যাব? মানে কোন দিক দিয়ে পার হওয়া যাবে?’ উত্তর আসে, ‘এখন তো খাঁড়ি পার হওয়া যাবে না। কাল সকালে পার হতে হবে।’ ‘তাহলে,’ হতোদ্যম তারা। অভয় আসে, ‘আমার পিছনে আসুন।’ অনেক ঘুরে ঘুরে, নালা পেরিয়ে, জঙ্গলের শেষে যেখানে তারা রাস্তায় ওঠে সেখান থেকে বেলাভূমির জনবসতি অন্তত এক কিলোমিটার। বিদ্যুৎহীন দ্বীপে নির্জন রাস্তায় শহরের একজোড়া যুবকযুবতী শক্ত করে পরস্পরের হাত ধরে, গায়ে গায়ে লেগে, জড়সড় হয়ে ফেরে সেই চায়ের দোকানে।
বন্ধুরা থানায় মিসিং ডায়রি করার আয়োজন করে ফেলেছে প্রায়। চায়ের দোকানের দিদি বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কী হয়েছে। ভ্যানওয়ালা ছেলেটিকে দার করিয়ে রেখেছে ওরা। এরমধ্যে অন্ধকার পথে দুজনের আগমন।
ভ্যানওয়ালা বলে, ‘আমি তালে আসি? আজ আর বেসি রাতে জলে যাবেন না। পুন্নিমা তো টান খুব।’ মাথার চুল উড়ছে তার। জ্যোৎস্নায় তার হাসিমুখ ঝকঝক করছে।
বন্ধুরে ছুটে আসে। জড়িয়ে ধরে দুজনকে। গালাগালি দেয়।
বন্ধুরা আসলে জানলার মতো। আলো দেয়। বাতাস দেয়। প্রাণবায়ু যাকে বলে।

(ক্রমশ)  

No comments:

Post a Comment